বড়দিনে, অন্য ইতিহাসের সন্ধানে- কলকাতার ফিরিঙ্গি কলোনি বো ব্যারাকে।
বড়দিন হয়ত খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব, কিন্তু এই উৎসবের আবেদন সার্বজনীন, এবং বিশ্বজনীন। সারা পৃথিবী জুড়েই জাতি-ধর্ম-বর্ন নির্বিশেষে এই উৎসব পালিত হয়।বড়দিনের উৎসবে ক্রিসমাস ট্রি, রঙিন টুনি দিয়ে যেমন ঘর সাজানো হয়, তেমনি কেক কাটা, পিঠে পুলি তৈরি, বিশেষ ডিনারের ব্যবস্থা,প্রিয়জনকে গ্রিটিংস কার্ড, উপহার দেওয়া ইত্যাদি যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। বড়দিনে প্রিয়জনকে উপহার দেওয়া নিয়েই তো লেখা হয়েছে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছোটগল্প " দ্য গিফট অফ দ্য ম্যাগি"। তবে বড়দিনের আগ্রহ ও আনন্দ বোধহয় সবচেয়ে বেশি উপভোগ করে , ছোট ছোট বাচ্চাগুলি। সান্তা ক্লজের কাছ থেকে পাওয়া যায় কত উপহার আর চকলেট।
সেই কোন সুদূর উত্তর মেরু থেকে সান্তা বুড়ো রওয়ানা দিয়েছে তাঁর নয়টা বলগা হরিণে টানা স্লেজ গাড়ি চেপে, পিঠের ঝোলায় ভরা কত উপহার। পৃথিবীর দেশে দেশে বাচ্চারা জেগে বসে থাকে সান্তা বুড়োর জন্য। কিন্তু বুড়ো যে ঠিক কখন চুপিচুপি এসে উপহার দিয়ে যায়, সেটা আর কোনদিন তাদের দেখা হয়না। ঘুম থেকে উঠে উপহার দেখে বাচ্ছাগুলির বিস্ময়ে ভরা গোল গোল চোখ আর মুখে যে হাসি দেখা যায়, আর কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে তা দেখা যায় কিনা জানিনা।
এবারে আসি বড়দিন ও এঙ্গলো ইন্ডিয়ান কলোনি বো ব্যারাকের প্রসঙ্গে।
সে প্রসঙ্গে যাবার আগে ছোট্ট করে এখানকার এবং সামগ্রিক ভাবে এঙ্গলো ইন্ডিয়ান সম্প্রদায়ের সম্মন্ধে কিছু নির্জলা সত্যি কথা জানাই।
কথা হচ্ছে এঙ্গলো ইন্ডিয়ান কারা ? সাদামাটা ভাবে বলা যায় মিশ্র রক্তের ইউরোপিয়ান( পড়ুন ইংরেজ পিতা) এবং এশিয়ান ( পড়ুন ভারতীয় মাতার) সঙ্কর জাত ইউরেশিয়ান সম্প্রদায় যারা জন্মেছিল ভারতে, ধর্মে ছিল খ্রিস্টান এবং মাতৃভাষা ছিল ইংরেজী। যেহেতু এরা দেখতে ছিল অনেকাংশে ইউরোপিয়ানদের মতন, ভাষা ও ধর্ম ভিন্ন , তাই ভারতীয়রা তাঁদের আপনজন বলে কখনও স্বীকার করেনি।
কিন্তু কেন এই বৈষম্য ?
স্বাধীনতার পূর্বোত্তর থেকে স্বাধীনতা পরবর্তীতেও দেশ ও দশের উন্নয়নের কাজে অসংখ্য ফিরিঙ্গির অবদান আছে। যেমন হেনরী লুই ডিরোজিও, জেমস কিড(যাঁর নাম থেকেই কিডের পুর বা খিদিরপুর), লেসলী ক্লডিয়াস, ফ্রাঙ্ক এন্থনী, রজার বিন্নী, কার্লটন চ্যাপমান, উইলসন জোন্স এবং এরকম আরো অনেকেই আছেন।বেশি পিছনে যাবার দরকার নেই, স্বাধীন ভারতের প্রথম অলিম্পিক গোল্ড আসে লন্ডন অলিম্পিকে, ১২ ই আগস্ট, ১৯৪৮ এ, ফিল্ড হকি থেকে, ৪-০ গোলে ব্রিটেন কে হারিয়ে। সেই খেলা নিয়ে তৈরি গোল্ড সিনেমা তো অনেকেই দেখেছেন, কিন্তু জানেন কি, সেই টিমে সর্বমোট ৯ জন এঙ্গলো ইন্ডিয়ান প্লেয়ার খেলেছেন। ফাইনালে বলবীর সিং দুটি গোল করেন। বাকি দুটি গোল করেন দুই এঙ্গলো ইন্ডিয়ান খেলোয়াড় Jansen এবং Pinto ,একটি একটি করে। আর হকিতে বিলাসপুর/ কলকাতার লেসলি ক্লডিয়াসের তিনটি সোনা এবং একটি রুপোর মেডেল জয়ের রেকর্ড হকির জাদুগর ধ্যানচাঁদেরও নেই।
সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার ছিল, খাঁটি ইংরেজরা এঙ্গলো দের সঙ্গেও দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকদের মতন ব্যাবহার করতেন।ইউরেশিয়ান দের নিয়োগ করা হতো রেল, খনি, পোস্ট অফিস ইত্যাদি চাকরিতে, কিন্তু খাঁটি ইংরেজরা সামাজিক বিত্ত এবং সম্মানের প্রশ্নে যোজন দূরত্ব বজায় রাখতেন ইনাদের সঙ্গে। বন্ধুবর অমিতাভ পুরকায়স্থ চমৎকার বলেছেন- " শাসক ও শাসিতের মধ্যে যে দৃঢ় সামাজিক ভেদরেখা তৈরি করতে চাইছিলেন ব্রিটিশ শাসকেরা, তা বারবার গুলিয়ে যাচ্ছিল এই মিশ্র রক্তের জনগোষ্ঠীর জন্য"। অর্থাৎ এদের ট্রাজেডি ছিল- এরা না ঘরকা, না ঘাটকা।
যাইহোক ফিরে আসি বো ব্যারাকে।
এই শহরের মধ্যেই লুকিয়ে আছে আরেকটি অন্য শহরের ইতিকথা। আত্মশ্লাঘায় ভরপুর বাঙালি, প্রায় সারা বছর তার কোন খোঁজই রাখেনা। প্রথম মহাযুদ্ধের সময় আমেরিকান সেনাদের থাকার জন্য মিলিটারি ব্যারাক হিসাবে প্রায় তিনবিঘা জায়গার ওপর দুই সারিতে, সাতটি ব্লকের এই লাল রঙের বাড়িগুলি তৈরি করা হয়। যেহেতু মিলিটারি ব্যারাক হিসাবে তৈরি, তাই এই বাড়িগুলির নান্দনিকতা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় নি।যুদ্ধের প্রয়োজনে ক্যালকাটা ইম্প্রুভমেন্ট ট্রাস্ট এগুলিকে তৈরি করে। যুদ্ধের শেষে আমেরিকান সেনারা দেশে ফিরে গেলে, হাত বদল হয়ে এগুলিতে চলে আসেন কলকাতার কিছু এঙ্গলো ইন্ডিয়ান সম্প্রদায়ের লোকজন।তবে যেকথা আগেই লিখলাম, এঁদের সম্মন্ধে আমরা নিতান্তই উদাসীন।
২০১৭ সালের বড়দিনে ছিলাম বো- ব্যারাকে । তখন দেখেছিলাম এখানকার বাড়িগুলির দশা নিতান্তই করুণ।এই অবহেলিত, জীর্ণ বাড়িগুলি দেখে আমার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া বিখ্যাত গানটির কথা মনে হয়-
" শোন বন্ধু শোন, প্রাণহীন এই শহরের ইতিকথা,
ইঁটের পাঁজরে, লোহার খাঁচায় দারুন মর্মব্যথা।
এখানে আকাশ নেই, এখানে বাতাস নেই,
এখানে অন্ধ গলির নরকে মুক্তির আকুলতা।"
এই আকুলতাকেই সঙ্গী করে এই বাড়িগুলিতে এখনও প্রায় ১৩২ টি পরিবার বাস করছে, যার বেশিরভাগই এঙ্গলো ইন্ডিয়ান সম্প্রদায়ের। তবে বো ব্যারাক কিন্তু একেবারে কসমপলিটান চরিত্রের। তাই এখানে এঁরা বাদ দিয়েও, বাঙালি, অবাঙালি, ভারতীয় চীনা সবাই মিলে মিশে আছেন।শুধু তাই নয়, এখানেই আছে ১ নম্বর বুদ্ধিস্ট টেম্পল স্ট্রীটের উপর " বৌদ্ধ ধর্মাঙ্কুর সভা"। সেন্ট্রাল মেট্রো স্টেশন থেকে হাঁটা পথে, চিত্তরঞ্জন এভেন্যু এবং বৌবাজারের মোড়ে, বউবাজার থানার পিছনেই অবস্থিত এই জীর্ণ বাড়িগুলিরই গাল ভরা নাম- বো ব্যারাক।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে একসময় এই বাড়িগুলি ভেঙে ফেলার কথা উঠেছিল। ভাগ্যিস ভেঙে ফেলা হয়নি, তাইতো এখনও খাঁটি হোম মেড ওয়াইন এবং এঙ্গলো ইন্ডিয়ান হেঁশেলের স্বাদ নিতে , বড়দিনের সময় সারা কলকাতার ইন্টেলেকচুয়াল বাঙালি হামলে পরে এখানে। তবে সত্যি কথা, ওয়াইন, কেক, বিভিন্ন ধরনের মাংসের রোস্ট ইত্যাদি বাদ দিলে, এদের কিচেনেও প্রায় ষোল আনা বাঙালি স্বাদ পাবেন খাবারে। মনে পড়ছে ম্যাকলাস্কিগঞ্জে ববি গর্ডনের বাড়িতে, ববির মায়ের হাতের রান্নার সঙ্গে আমার মায়ের হাতের রান্নার স্বাদের আদৌ কোন তফাৎ লাগেনি। চীনা রান্নার বিভিন্ন পদও এরা সাগ্রহে তৈরি করে।
কেউ কেউ বলেন যে, কে আই টি নাকি এই ফ্লাট গুলি বাসিন্দাদের বিক্রি করে দিয়েছে, আবার indian Express এ দেখছি তা নয়। এখানে এখনো মান্ধাতা আমলের বাড়ি ভাড়া ৩০/- টাকা বজায় আছে, যা কে আই টি নিতে অস্বীকার করে।KIT এবং KMDA ১৯৯৯ সাল থেকে এই বিপদজনক বাড়িগুলি ভেঙে,বর্তমান বাসিন্দাদের জন্য, নতুন করে হাউসিং কমপ্লেক্স তৈরির চেষ্টা করেছিল। ২০১৭ সালে মোটামুটি ৪০ মিনিটের জন্য পানীয় জল ছাড়া আর কোন পরিষেবা KIT থেকে পাওয়া যেত না। এছাড়া পুরো কমপ্লেক্স পরিষ্কারের কাজে তখন একজন মাত্র সুইপার বহাল ছিল ।
পরিষেবা বন্ধ, জীবন হাতের মুঠোয় নিয়ে বেঁচে থাকা, অধিকাংশ বাসিন্দাই বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, তবুও এঁদের বেঁচে থাকার অদম্য ইচ্ছাশক্তি এবং মনোবল অটুট। নিজেদের মধ্যে ক্লাব, হাউসি, পার্টি, হোম মেড ওয়াইন, বলডান্স ইত্যাদি নিয়ে এরা হৈ হুল্লোড় করেই থাকেন। আর যখন ঘরে একা থাকেন, তখন নীরবে চোখের জল ফেলেন- ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড প্রবাসী ছেলে-মেয়ে, নাতি নাতনীর জন্য।
এক নামি পরিচালক কিছুদিন আগে বো ব্যারাক নিয়ে একটি ছবি করেছিলেন ।অনেকেই হয়ত ছবিটা দেখেছেন।অনেকের হয়ত মনে হতে পারে, এরা যখন এত হুল্লোড়ে তখন হয়ত কিছুটা উশৃঙ্খল এঁদের জীবনযাত্রা। কিন্তু আদপেই তা নয়। এরা অত্যন্ত অবহেলিত সম্প্রদায়, মাছে- মাংসে- ভাতে এরাও কিন্তু আমাদেরই মতন ছাপোষা ভদ্রলোক।
আমরা যতই গান গাইনা কেন- শক হন দল পাঠান মোগল একদেহে হোল লিন- স্বাধীনতার পূর্বে এবং পরেও, এই ফর্সা, কটা চোখের ট্রেনের ড্রাইভার/ গার্ড/ কলিয়ারীর ওভারম্যান/সওদাগরি অফিসের টাইপিস্ট বা পি এ দের কখনও অন্তর থেকে আপন করে নিতে পারিনি, আমাদের চোখে এই হতভাগ্য লোকগুলি কলোনিয়াল যুগের প্রতিভূ। সেজন্য একদা যে লোকগুলি নিজেদের মুলুক তৈরি করেছে ভারতে, রাঁচির কাছে ম্যাকলাস্কিগঞ্জে, সগর্বে বলেছে ইন্ডিয়া ইজ আওয়ার মাদারল্যান্ড, অসংখ্য ইংরেজি মাধ্যমের ভালো স্কুল স্থাপনা থেকে প্রথম অলিম্পিক গোল্ড মেডাল অর্জনে যাঁদের বিশাল ভূমিকা ছিল, তাঁরা কিন্তু পরিষ্কার বুঝে গেছে এদেশে এখনও তাঁরা অবাঞ্ছিত। রাজনৈতিক ও সামাজিক পালাবদলের ঝড় এই মানুষগুলির পক্ষে শুভ সংকেত বয়ে আনেনি। এরই নিটফল আজকের এঙ্গলো ইন্ডিয়ান নতুন জেনারেশনের ম্যাসিভ এক্সডাস বা দেশত্যাগ। কলকাতার বো ব্যারাক থেকে রাঁচির ম্যাকলাস্কিগঞ্জ সর্বত্র একই ইতিহাস। ক্রিসমাসের সময়ের বো ব্যারাকের রঙীন ছবিই সব নয়। অন্য সময় এসে এঁদের সঙ্গে আলাপ করেই দেখুন না।ক্রিসমাসের সময় দুপুর/বিকালে এসে এঁদের হেঁশেলের স্বাদ নিতে পারেন। সন্ধ্যার পরে কেবল হৈ চৈ, তখন আবার অন্য এক ধরণের মজা, থিকথিক করছে লোক, ক্যামেরা, ফটোগ্রাফার, মিডিয়ার ভিড়ে জায়গা পাওয়াই দায়।
বো ব্যারাক শুধুমাত্র একটি বিশ্বযুদ্ধের ঐতিহাসিক স্মারক নয়। এঙ্গলো ইন্ডিয়ান সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যবাহী বহমান ইতিহাসের সাক্ষী এটি।
সান্তাক্লজ রিকশা চেপে একমাত্র বোধহয় এইখানেই নামেন। খ্রিস্টমাসের অন্তত ১ সপ্তাহ আগে থেকেই এখানে সাজোসাজো রব পরে যায়, খেলাধুলা থেকে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে ফুড প্যাকেট বিতরণ করা , সংগীতানুষ্ঠান ইত্যাদি বহু অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। পার্ক স্ট্রিট কার্নিভালের গ্রান্জার এখানে পাবেননা, পাবেন ইতিহাসের মোড়কে এক হৃদয়স্পর্শী অনুভূতি।
কেন যে বো ব্যারাকের বাড়িগুলিকে হেরিটেজ বলা হচ্ছেনা, জানিনা।
চলুন এবার বড়দিনে- অন্য ইতিহাসের সন্ধানে- বো ব্যারাকে।
ছবি: বো ব্যারাকে বড়দিনের সন্ধ্যায়।
2)ইঁটের পাঁজরে বিশ্বযুদ্ধের অজস্র ছাপ, কলকাতার নস্টালজিয়ায় 'অ্য।্লো্' পাড়ার রঙিন ইতিহাস।দোলন চট্টোপাধ্যায়। News18BANGLA, August 2, 2017