অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করেই, দ্বীপান্তরী হওয়ার ইচ্ছা জেগেছিলো নির্ঘাৎ, সে কারণেই বাস না করেও, অগ্রদ্বীপ যাওয়ার বাসনা হলো আমার। আসল আকর্ষণটি অবশ্য আলাদা- হ্যাঁ, সঙ্কর্ষণ-অনুজের দর্শন। অগ্রদ্বীপের অধিষ্ঠাতা দেবতা শ্রী শ্রী রাধা-গোপীনাথ জিউ। বিগত পাঁচ শতক ধরে তিনি এখানে স্বমহিমায় বিরাজমান। তাই সাত-পাঁচ না ভেবে, সোজা হাতে ক্যামেরা, পিঠে ব্যাগ। আর, মনে এক মধুগীতি- "আনো তব তাপহরা, তৃষা-হরা সঙ্গ সুধা, বিরহিণী চাহিয়া আছে আকাশে - এসো শ্যামল-সুন্দর!"
শ্রী শ্রী গোপীনাথ মন্দির, অগ্রদ্বীপসকাল ৭.১০ এর বর্ধমান লোকাল ধরে, চলে এলাম ব্যাণ্ডেলে- বেলুড় থেকে। এখান থেকে যাত্রা শুরু করতে হবে, কাটোয়া লোকালে। কাটা কাটা যাত্রা হলেও, কাটোয়া লোকালই এক্ষেত্রে যাত্রার শর্টকাট। সময় ৮.১০। সরাসরি ১০ টার মধ্যে পৌঁছে দিলো অগ্রদ্বীপ।
গোপীনাথ মন্দির প্রতিষ্ঠাতা গোবিন্দ ঘোষঠাকুরের সমাধি মন্দিরস্টেশনে নেমে টো টো করে না ঘুরে, টোটোর সন্ধান করাটাই সমীচীন বলে মনে করলাম। কিছুটা হেঁটে, পেয়েও গেলাম একখানা। ফেরী ঘাটই এখন গন্তব্য। তবে, রাস্তার অবস্থা কিছু জায়গায়, নয় কহতব্য। সভ্য-ভব্য অবস্থায় হাড় ক'খানা নিয়ে গন্তব্যে পৌঁছানোটাই সম্ভাব্য কী না, সে চিন্তাই যাত্রাপথের কিছুটা সময় আমার মুখ্য উপজীব্য হয়ে উঠলো। জীবনের উত্থান-পতনের সাথে তাল রেখে, এ রাস্তাকেও "ওয়ে অফ লাইফ" বলাই যায়- এ নিছক সমাপতনও নয়।
দোল মন্দির, অগ্রদ্বীপসে যাই হোক, আমার রথীটি হাড়গোড় সমেতই আমায় ভাগীরথীর কূলে পৌঁছে দিলো। আমিও অকূলে কূল পেলাম। এখানের ভাগীরথী একেবারেই শীর্ণকায়া, মন্দস্রোতা। নৌকা পারাপারের বন্দোবস্ত আছে, তবে এ বন্দরটি খুব একটা কেতাদুরস্ত নয়। মাটীর একটু ঢালু পাড়, সামলে না চললে হয় গঙ্গাপ্রাপ্তি আর নয়তো মাটী নেওয়া ঠেকানো মুশকিল। সে যাই হোক, অপর পাড়ে পৌঁছে পারানি দিয়ে যাত্রা শুরু করলাম একটি টোটো-তে।
বেশ মনোরম রাস্তাটি। মোরামে মোড়া, লালে লাল। একটু যেন রুক্ষ , ধূলিধূসরিত পরিবেশ। প্রায় পনেরো মিনিট বাদে গোপীনাথ মন্দিরের সামনে এসে নামলাম।
শ্রী শ্রী রাধা- গোপীনাথ জিউ বিগ্রহ, অগ্রদ্বীপকিন্তু এ কী?? বিধি বাম। আমার অবতরণিকা যে গৌরচন্দ্রিকাতেই উপসংহার প্রাপ্তি হলো! সমতল ছাদ বিশিষ্ট, সুদৃশ্য দালান মন্দিরটি তালা বন্ধ!
শ্রী শ্রী রাধা- গোপীনাথ জিউ বিগ্রহ, অগ্রদ্বীপএতো তত্ত্ব-তালাশের শেষে, এভাবে যে সব সুর বেতালা হয়ে যাবে, ভাবিনি। হঠাৎই একজন পথচলতি মানুষই বাতলালেন পথ- উপযাচক হয়েই। শ্রী গোপীনাথ এখন মূল মন্দিরের সংস্কার কাজ চলায়, অস্থায়ী ভাবে অবস্থান করছেন দোল মন্দিরে। এটি মূল মন্দিরের অদূরেই অবস্থিত।
দোলাচলচিত্ত না হয়ে, সোজা দোল মন্দিরেই যাত্রা করলাম। এটিও কম নয়নাভিরাম নয়- দালান মন্দিরের মতোই আকৃতি, কিন্তু উপরে রয়েছে মনোহর একটি চূড়া।
ভেতরে বেশ ভীড়। বহু ভক্ত সমাগম হয়েছে। তিলমাত্র কালবিক্ষেপ না করে, যথাসম্ভব শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে, বসলাম বিগ্রহের সামনে!
নটবরের বরানন দেখে আমি তখন স্পিকটি নট! কী অপূর্ব, করুণাঘন মোহনমূর্তি! কোমরের ত্রিভঙ্গ, পরনের পীতধড়া, ঈষৎ বঙ্কিম অধরে শুচিস্মিত হাসি, আয়ত নয়ন, স্বর্ণমুরলী, বর্হাবতংস সহ এক প্রেমঘন ছবি শ্রী শ্রী গোপীনাথ জিউ-এর। পাশে শ্রীরাধারানীর মূর্তিটিও অনুপম। দেবী তপ্তকাঞ্চনবর্ণা, শুভস্মিতা, প্রফুল্লবিম্বাধরা, বরাননা। এই মূর্তি দেখে চোখ আর মনের পিপাসা বেড়ে গেলো অনেকখানি। কিন্তু ভাগ্যের পাশা যে উল্টে যাবে, তা ভাবতে পারিনি তখনো। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি।
মন্দিরের প্রতিষ্ঠাকাল আনুমানিক ষোড়শ শতক। মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেবের এক পার্ষদ, শ্রী গোবিন্দ ঘোষঠাকুর এই মূর্তি ও মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা। এক টুকরো মুখশুদ্ধি সঞ্চয়ের কারণে, গৃহত্যাগী পরম বৈষ্ণবের "মাধুকরী " ব্রতবিচ্যুত হন তিনি। অতঃপর, মহাপ্রভুর আদেশেই তিনি অগ্রদ্বীপে এই মনোহর মূর্তিটি স্থাপন করে, সংসারী হয়েও কৃষ্ণধ্যানে মনোনিবেশ করেন। তাঁর শিশুপুত্র মাত্র পাঁচ বছর বয়সে মারা যাওয়ায়, তিনি গোপীনাথ জিউকেই সন্তানস্নেহে পূজার্চনা করতে থাকেন। কালের নিয়মে তিনি যখন মৃত্যুশয্যায়, কথিত আছে, স্বয়ং গোপীনাথ জিউ তাঁর আত্মার শান্তির জন্য পারলৌকিক ক্রিয়াকর্ম স্বহস্তে সম্পাদন করবেন বলে স্বপ্নাদেশ দেন। কোনো এক বারুণী স্নানের পূর্বে, চৈত্র একাদশী তিথিতে ঘোষঠাকুর গোলোকধামে গমন করেন। অতঃপর, সেই সময় থেকে অদ্যাবধি, পরম করুণাময় গোপীনাথ জিউ, শ্রাদ্ধের উপযুক্ত পোশাক পরে কাছা নিয়ে, উক্ত তিথিতে ঘোষঠাকুরের শ্রাদ্ধ করেন। কাতারে কাতারে লোক আসে প্রতি বছর, এ সময়ের বিরাট মেলা ও এই অপার্থিব শ্রাদ্ধানুষ্ঠান দেখতে। তাঁরা বাড়ী ফেরেন বারুণী স্নান সেরে। বিশ্বদেবের এই বাৎসল্যরীতি, এই করুণা, এই মন-ছোঁয়া সহজিয়া আত্মীয়তার মাধুর্য, সত্যি এই মন্দিরকে দিয়েছে অনন্য এক মাত্রা। মূল মন্দিরের পাশেই একটি অনাড়ম্বর মন্দিরে সমাহিত আছেন প্রতিষ্ঠাতা গোবিন্দ ঘোষঠাকুর। গোপীনাথের মনলোভা রূপ, কখনো শোভাবাজারের রাজা নবকৃষ্ণ দেব, কখনো বা পাটুলীর জমিদার বংশ, এমনকি, পূর্ববঙ্গের(অধুনা বাংলাদেশ) বেশ কিছু সম্ভ্রান্ত ভক্তকূলকে আকৃষ্ট করেছে। বিভিন্ন সময় গোপীনাথ জিউকে তাঁরা নিজ গৃহে, বা বাসস্থানে নিয়ে গেছেন- ছলে, বলে, কৌশলে। কিন্তু, ভাগ্যের পরিহাসে ভাগ বসাতে পারেননি কেউই, অগ্রদ্বীপবাসীদের সৌভাগ্যে৷ কোনো না কোনোভাবে, আবার ঠিক স্বস্থানে ফিরে এসেছেন দেবতা। অহঙ্কারীর স্বর্ণদেউল নয়, কপটতাহীন ভক্তহৃদয়েই তাঁর অধিষ্ঠান।
পূজার্চনা, শ্রীকৃষ্ণ স্তোত্রপাঠ, যুগলস্তোত্রপাঠ, মহানাম জপ, রাধাস্তোত্র পাঠ ইত্যাদি সুষ্ঠুভাবে সুসম্পন্ন হলে, পা বাড়ালাম অগ্রদ্বীপ স্টেশনের দিকে। মন্দিরের পুরোহিত মশাইয়ের রেওয়াজি কণ্ঠস্বরে ওস্তাদি ঢংয়ের মার্গসঙ্গীত, ভজন ইত্যাদি আরাত্রিকের সময়কে মাতিয়ে তুলেছিলো।
এবার আসি আমার দুর্ভাগ্যের কথায়। স্টেশন থেকে আসার সময়, প্ল্যাটফর্মে টাঙানো টাইম চার্টে সরাসরি দেখলাম, দুপুর ১.১৪ তে একটি ব্যাণ্ডেল-কাটোয়া লোকাল রয়েছে। কিন্তু ননীচোরা গোপী যে ট্রেনের টাইমটেবলেও পুকুরচুরি করে, আমার মাথায় ভালোমতো টুপি পরাবেন, তা তখনও বুঝিনি। ট্রেনটি ক্যানসেল্ড, পরের ট্রেন ৩.৩৯ এ!
এতোক্ষণ বসে থাকা সম্ভব নয়। আমার আবার নবদ্বীপে সেদিনই, বিখ্যাত "সাত শিবের পৌষল্লা" অনুষ্ঠানটি দেখতে যাওয়ার কথা। কিন্তু, এখন সে-সব বিশ বাঁও জলে। কারণ, ৩.৩৯ এর গাড়ী ধরে যেতে হলে, অন্তত চারটের আগে বিষ্ণুপ্রিয়া হল্ট পৌঁছনো যাবে না। ততোক্ষণে অনুষ্ঠানের অণুমাত্রও অবশিষ্ট থাকবে না।
বিরক্তিতে মনটা ভরে উঠলো। তাই, দ্বিরুক্তি না করে ভাবলাম, "চলো মন রূপনগরে"! রূপসাগরের অরূপরতনের সন্ধান দিয়েছিলেন সাহিত্যিকপ্রবর শ্রী সমরেশ বসু। অগ্রদ্বীপের কাছেই, পাটুলীর জামালপুর গ্রামে অবস্থান করছেন অনাদিলিঙ্গ শিব, বাবা বুড়োরাজ! ধর্মরাজ এর " রাজ", আর বুড়োশিবের "বুড়ো"- এই দুই মিলিয়ে " বুড়োরাজ!" ইনি গ্রামদেবতা হলেও, আলোচ্য স্থানে তিনি অত্যন্ত বিখ্যাত, ও প্রাচীন।
প্রাচীনত্বের বিচারে জামালপুরের বুড়োরাজ, অগ্রদ্বীপের গোপীনাথ জিউ-এর সমসাময়িক। তবে, এই লিঙ্গের মূল প্রতিষ্ঠাতা কে, তা জানা যায়নি। এ কারণেই এঁকে "অনাদিলিঙ্গ" নামে ডাকা হয়। কিংবদন্তী অনুসারে, জামালপুরের পার্শ্ববর্তী গ্রাম নিমদহের এক সম্পন্ন গোপালক, শ্রী যদু ঘোষ এই মূর্তির আবিষ্কারক। কথিত আছে, তাঁর দুগ্ধবতী একটি গাভী শ্যামলীর দুধ হঠাৎ করেই কমে যেতে থাকে একসময়৷ বহু অনুসন্ধান করেও এর ব্যাখ্যা খুঁজে না পেয়ে, একদিন যদু ঘোষ নিজেই গোপনে অনুসরণ করেন শ্যামলীকে। অপার বিস্ময়ে তিনি দ্যাখেন, চারণক্ষেত্র থেকে গোপনে শ্যামলী পলায়ন করে, গভীর জঙ্গলে প্রবেশ করে, একটি মৃত্তিকাস্তূপের ওপর অঝোরধারায় দুধ ঢালছে! এই অলৌকিক ঘটনা লক্ষ্য করে, তিনি গ্রামের প্রাচীন ও বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ শ্রী মধুসূদন চট্টোপাধ্যায়কে আনুপূর্বিক সমস্ত বিবরণ খুলে বলেন। স্থানীয় বাগদি সম্প্রদায়ের সহায়তায় তাঁরাই শিয়াকুল-বাবলা ইত্যাদি গাছের ঘন জঙ্গল পরিষ্কার করে, বাবা বুড়োরাজের শিলামূর্তিটি আবিষ্কার করেন সেই মৃত্তিকাস্তূপের ভেতর থেকে। বাবার স্বপ্নাদেশ অনুযায়ী, একটি বাহুল্যবর্জিত খোড়ো ঘরে মাটীর মেঝেতে, একটি পোহানের মতো গহ্বর খুঁড়ে তাঁর আরাধনা শুরু করা হয়। শুধু পরমান্ন, অর্থাৎ পায়েস দিয়েই এখানে দেবতার ভোগদান করার বিধি। প্রথম পূজা যেহেতু যদু ঘোষের নামেই হয়েছিলো, তাই আজও সেই রীতি বজায় আছে। এখনো বাৎসরিক গাজনের সময় প্রথম বলির পশুটি আসে নিমদহ গ্রামবাসীদের তরফ থেকেই। বুড়োরাজের পূজায় অগ্রাধিকারও তাঁরাই পান- কেননা যদু ঘোষের কোনো বংশধরই আজ আর জীবিত নেই। মধুসূদন চট্টোপাধ্যায়েরও জামাতা বংশ তথা বন্দ্যোপাধ্যায়রাই এখন এই ঠাকুরের সেবায়েত, কারণ চট্টোপাধ্যায় বংশও আজ কালের গর্ভে নিশ্চিহ্ন। একই লিঙ্গে এখানে ধর্মঠাকুর, আর শিবের অবস্থান। একই থালায় নিবেদিত নৈবেদ্যর মধ্যে একটি সূক্ষ্ম দাগ কেটে, দুটি ভাগ যথাক্রমে সূর্য ও শিবমন্ত্রে নিবেদন করা হয় দুই দেবতাকে। আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, শিবের নামে নয়, বরং ধর্মঠাকুরের নামে এখানে একাধিক যূপকাষ্ঠে অজস্র বলিদান করা হয়। পাঁঠা, মোষ, হাঁস, মুরগী থেকে শূকর- সব রকমই বলির বিধি আছে। সমাজের তথাকথিত অন্ত্যজ সম্প্রদায়ের মানুষই অত্যন্ত জাগ্রত ও বিখ্যাত, প্রাচীন এই দেবতার মূল ভক্ত। এই দেবতার গাজন হয় বুদ্ধপূর্ণিমার সময়ে। তখন, ধারালো অস্ত্র হাতে শতসহস্র ভক্তের সমাগম, দণ্ডি কাটা, লাঠিখেলা, ঢিল বাঁধা, হত্যা দেওয়া, বাণ ফোঁড়ানো, মেলা, বলিদান ইত্যাদির ফলে, নিরিবিলি পল্লীগ্রামটি সরগরম হয়ে ওঠে - মানুষের মহামিলন ক্ষেত্রে পরিণত হয়। এছাড়াও, শিবরাত্রি, মাঘী ও বৈশাখ পূর্ণিমাতেও হয় মহোৎসব।
এ সব তথ্য জানতে পেরেছিলাম শ্রী সমরেশ বসু-র উপন্যাস পড়েই। তাই ভাবলাম, শৈবতীর্থ ভ্রমণেচ্ছা বিকল্প পথে পরিপূর্ণ করতে, এই মন্দিরের অনুকল্প নেই।
একজন সহৃদয় মুসলিম টোটোচালক সহায়তা করলেন আমার৷ তাঁর দিকনির্দেশ অনুযায়ী, প্রথমে অটোযোগে গড়াগাছা মোড় এলাম, অগ্রদ্বীপ স্টেশন থেকে। তারপর সেখান থেকে যাওয়ার কথা ছিলো ছাতনি-র মোড়। কিন্তু, বহুক্ষণ অপেক্ষা করেও যখন বাসের ছাতটুকু দ্যাখার আশাও "নিল" বলে বুঝলাম, তখন প্রায় দ্বিগুণ ভাড়ায় এক টোটোচালককে রাজী করিয়ে, সরাসরি এলাম পাটুলী স্টেশনে। অনভিজ্ঞতার দরুণ, এখানেই হয়ে গেলো মহা ভুল। কারণ পাটুলী স্টেশন থেকে আবারও যখন অটো ভাড়া করে মন্দিরে যাচ্ছিলাম, পথে ঐ ছাতনির মোড়ই পড়লো। দোষটা আমারই, কারণ আমিই টোটোচালক দাদাকে প্রথমে ছাতনির মোড় যাবার কথা বললেও, পরে যখন ওনাকে জানাই যে আমি পাটুলী স্টেশন যাবো, উনি তখন শর্টকাটে বড়ডাঙা থেকে পাটুলীর রাস্তা ধরেছিলেন- যা কিনা ছাতনির মোড়-এর অনেকখানি আগে। জামালপুর যেতে হলে যে ছাতনির মোড় থেকেই টোটো বা অটো পেয়ে যেতাম, সেটা পরে জানলাম। আসলে, "চলো মন রূপনগরে"-তে লেখকবর্ণিত পথটি হুবহু অনুসরণ করাতেই এই প্রমাদ ঘটেছে।
বিভিন্ন আকৃতির গোপাল মূর্তি, শ্রী শ্রী বুড়োরাজ মন্দিরসে যাই হোক, পাটুলী স্টেশন থেকে জামালপুর অনেকখানি পথ, অবস্থাও তথৈবচ। কিন্তু, চারপাশের দৃশ্য খাঁটি অ্যাপেটাইজার। গম্ভীর ভাবে দাঁড়িয়ে থাকা প্রাচীন শালবন, ঝিমঝিমে জলের একটি ছোট্ট ক্যানেল, " সঙ্গীবিহীন অন্ধকারে" একা দাঁড়ানো মাছরাঙাটি, পূর্বরাগের আবেশে উল্লসিত সর্ষেক্ষেত- শীতকালীন আমেজের নাম লিখেছে শেষ দুপুরের মিঠে রোদ্দুরে। এই আবেশে বুঁদ হয়ে বহু পথ পেরিয়ে, অবশেষে এসে নামলাম গন্তব্যে।
পূজা-আর্চার দোকান, মণিহারি সামগ্রীর দোকান ইত্যাদি মিলিয়ে স্থানটি জমজমাট। নাটমন্দির পেরিয়ে প্রাঙ্গণ, তার শেষে একটি ছোট্ট কুটির। এখানেই নিকোনো মাটীর গহ্বরের মধ্যে দেবতার অবস্থান। আমি যখন গেছিলাম, তখন পূজা শেষে মন্দির সাফসুতরো করার কাজ চলছিলো। তবু, আমার অনুরোধে পুরোহিতমশাই আমার পূজাটি দিনের শেষ পূজা হিসেবে উৎসর্গ করলেন। দেবশিলার আকৃতি অনেকটা অশোকস্তম্ভের মতো- একদিকটা কিছুটা উঁচু, অপরদিকে একটি অগভীর গর্ত। যথাক্রমে এই দুটি দিক, বুড়োশিব ও ধর্মরাজের প্রতীক। মাঝখানের অংশটিতে নানারকম আঁকিবুঁকি দাগ।
মন্দিরের পাশে অন্য একটি জায়গায় পালে পালে গোপাল মূর্তি দেখতে পেলাম। মন্দিরের ওপর অশ্বত্থ ও নিমগাছের ছায়া, পাশে একটি পুকুর, যূপকাষ্ঠে উৎসর্গীকৃত বলির পশুর শুকনো রক্তধারা, দুধ ও গঙ্গাজলের স্রোত- সবটা মিলিয়ে এক ভয়ঙ্কর সুন্দর পরিবেশ। পাশের মাঠে দলে দলে তীর্থযাত্রী ঢাক বাজিয়ে দেবতার মাহাত্ম্য কীর্তন করছে। কোথাও আবার চলছে বনভোজনের ঢঙে বলির মাংসের মহাপ্রসাদ গ্রহণ। আদিত্য হৃদয় স্তোত্রপাঠ, শিবরক্ষা ও শিবপঞ্চাক্ষর স্তোত্রপাঠ শেষে, রওনা হলাম পাটুলী স্টেশনের পথে।
যুগলবিগ্রহ, অনাদিলিঙ্গ, শ্রী শ্রী বুড়োরাজ ঠাকুরএখানে উল্লেখ্য, এরপর আমি নবদ্বীপে পোড়ামাতলা এবং যোগনাথতলা মন্দিরও দর্শন করেছিলাম, কিন্তু এই মন্দিরগুলির কাহিনী সর্বজনবিদিত হওয়ায়, এবং ইতিমধ্যেই সুদীর্ঘ এই আলোচনার অনাবশ্যক কলেবর বৃদ্ধির আশঙ্কায়, এখানেই ইতি টানছি। শুধুমাত্র ছবিগুলিই থাকলো স্মারক হিসেবে।
সুপ্রাচীন এই দুই মন্দির মানবমিলনের মহাতীর্থ। ভক্তপ্রাণ পায় ভক্তির ফল্গুধারা, ইতিহাসবিদ পান ঐতিহাসিক গবেষণার উপাদান, মানবপ্রেমী পান "প্রকৃতির গভীরে জীবলীলা"-র সন্ধান। আর আমি শুনেছি পথের গান, ঘর ছাড়ার গান, রূপনগরের সন্ধান। তাই আমার সনির্বন্ধ অনুরোধ থাকবে গ্রুপের সমস্ত মাননীয় ভ্রমণবিলাসীদের কাছে, একবার এই " আগুনের পরশমণি " প্রাণে ছুঁইয়ে দ্যাখার!
★★পথনির্দেশ★★
১. সকালে ৮-১২ টা
২.বিকেলে ৫-৮ টা।
প্রতিদিন সকাল ৮ টা-দুপুর ১.৩০টা। শুধু প্রতি সোমবার করে দুপুর ৩.৩০ টে অবধি মন্দির খোলা। এই মন্দির সন্ধ্যা বেলায় বন্ধ থাকে।
১." বাংলার মন্দিরের খোঁজে "-অধ্যাপক শ্রী শ্যামল কুমার ঘোষ।
২. " চলো মন রূপনগরে"- শ্রী সমরেশ বসু।
Arghya Biswas











0 comments:
Post a Comment