Friday, December 6, 2019

চাঁদিপুর,পঞ্চলিঙ্গেশ্বর,কুলডিহা, বাংরিপোসি,সিমলিপাল - Chandipur, Panchalingeswar, Kuldiha, Bangriposi, Simlipal

আমিও একজন ভ্রমণ পাগল মানুষ।
এবার আমি এমন একটা ট্যুর প্ল্যান করতে চাইছিলাম, যেখানে একাধারে,
1. নির্জন সমুদ্র সৈকতের একাকীত্ব উপভোগ করতে পারবো,আবার ,
2. পাহাড়ের ঘ্রাণ নিতে পারবো,সেই সঙ্গে,
3. গভীর জঙ্গলের সবুজ চাদর গায়ে জড়িয়ে নিতে পারবো, আবার,
4. জলপ্রপাতের গর্জন শুনতে পারবো, তৎসহ,
5. নদী বাঁধের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবো,আর এর সাথে,
6. একটু ধর্মীয় কিছু স্থান ঘুরে দেখবো।

সিমলিপাল জঙ্গলের ম্যাপ
                                                            সিমলিপাল জঙ্গলের ম্যাপ

অনেক ভেবেচিন্তে এমন একটা ট্যুর প্ল্যান করে ফেললাম,যেখানে আমার সবকটি চাহিদাই পূরণ হবে। ঠিক করলাম আমার ট্যুর শুরু হবে,উড়িষ্যার চাঁদিপুর সমুদ্র সৈকত দিয়ে,


তারপর পঞ্চলিঙ্গেশ্বর হয়ে কুলডিহা ফরেস্ট,সিমলিপাল ফরেস্ট,আর বাংরিপোসি ঘুরবো।

চাহালা ওয়াচ টাওয়ার
                                                                    চাহালা ওয়াচ টাওয়ার

কিন্তু,সমস্যা হলো কবে যে উড়িষ্যা সরকার জঙ্গল সাফারী শুরু করার অনুমতি দেবেন, তা সঠিক ভাবে কেউই বলতে পারছিলো না।তবে খোঁজ খবর নিয়ে জানলাম,নিশ্চিত রূপে না হলেও, নভেম্বরের এক তারিখে জঙ্গল খুলে যাওয়ার একটা ক্ষীণ সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।তখন মনের নদীতে সাহসের নৌকা ভাসিয়ে দিয়ে, হোটেল বুক করে ফেললাম।এখানে একটা ব্যাপার উল্লেখ্য না করলেই নয়,যে,এই গ্রুপের অনেক পোস্ট ঘেঁটে আমি প্রচুর তথ্য পেয়েছিলাম,যা আমার ট্যুর সাজাতে ভীষণ সাহায্য করেছিলো।
                                                        ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ীর মেন গেট
প্রথম দিন (30.10.20) ::
ভোর ঠিক 5:20 তে গাড়ি স্টার্ট করে কোলাঘাট হয়ে,বালাসর হয়ে বেলা 10;30 এ'পৌঁছে গেলাম, চাঁদিপুর সমুদ্র সৈকতে অবস্থিত OTDC এর হোটেল, "পান্থনিবাসে"।গাড়ির ইঞ্জিনকে একটু বিশ্রাম দেওয়া, আর সেই অজুহাতে,বাড়ি থেকে রান্না করা খাবার দিয়ে,ব্রেকফাস্ট সেরে ফেলার কাজটা পথেই করে ফেলেছিলাম।

                         সিমলিপাল খইরি রিসর্ট এর মেন গেট থেকে সূর্যাস্তের সময় তোলা

পান্থনিবাস হোটেল, চাঁদিপুর সমুদ্র সৈকতের সেরা লোকেশনে অবস্থিত।খাবার দাবার যথেষ্ট ভালো।ঘর ভাড়া ন্যূনতম 1200 টাকা(কর অতিরিক্ত)।রুম অনলাইনে বুক করা যায়।
এখানকার সমুদ্রের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো,সমুদ্র প্রতিদিন 7km দূরে সরে যায়,আবার প্রতিদিনই ফিরে আসে।

                                                                বালাসরের ঈমামী জগন্নাথ মন্দির
বিকালবেলা টুক করে ঘুরে এলাম,পাশেই বুড়িবালাম নদীর মোহনা থেকে।এখানে জেলেদের মাছ ধরার বড় বড় কমলা-কালো নৌকা নোঙর করা আছে।জেলেদের বড় বড় জাল,শুটকি মাছ রৌদ্রে সান বাথ নেয়।ঝাউবনের ফাঁকে সমুদ্র উঁকি মারে।
                                                                    খুমকূট ড্যাম

সেইদিন পূর্ণিমা (তাও আবার ব্লু মুন ) হওয়ায় সমুদ্র, সন্ধ্যাবেলা থেকেই অসাধারণ রূপ ধারণ করলো,যা চোখ আর মনকে আনন্দে ভরিয়ে তুললো।


                                             নীলগিরি পাহাড়ের লাগোয়া,গোবিন্দ যাত্রী নিবাসের খোলা ছাদ
দ্বিতীয় দিন (31.10.20) ::
বেড়াতে গিয়ে বেলা অবধি ঘুমানো আমার ঠিক ভালো লাগে না।ভোরের স্নিগ্ধ বাতাসে, বালুকা বেলায় ছোট্ট একটা কোস্টাল ট্রেকিংয়ে বেরিয়ে শুধুই মনে হচ্ছিলো, প্রকৃতির কি অপরূপ লীলা!গতকাল রাতেই যে সমুদ্র রাগে গর্জন করছিলো, সে আজ ভোরের আলো ফোটার আগেই অভিমান করে চুপিসারে কোথায় চলে গেছে!!!সন্ধ্যায় যদি আজ সে, ফিরে না আসে?

                                                         যোশিপুর যাওয়ার পথ

সকাল সকাল স্নান সেরে যখন চেক আউট করলাম,তখন ঘড়িতে প্রায় আট টা বাজে ।আজ প্রথমেই যাবো,পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের আদলে তৈরি,বালাসরের ঈমামী জগন্নাথ মন্দির দেখতে।
এই মন্দির অত্যন্ত সুন্দর,পরিস্কার, ঝাঁ চকচকে।তবে প্রবেশের অনুমতি পেলেও কোভিডের কারণে পূজা দেবার অনুমতি পাওয়া গেলো না।

                                                            সিমলিপাল জঙ্গলের ভিতরে প্রবেশ করেই

এবার চললাম পঞ্চলিঙ্গেশ্বরের উদ্দেশ্যে।আমরা আজ থাকবো, "গোবিন্দ যাত্রী নিবাসে"।হোটেলে ঢুকলাম 10 টা নাগাদ।আমার মতে এই হোটেলটি পঞ্চলিঙ্গেশ্বরের বেস্ট লোকেশন(পান্থনিবাসের থেকেও ভালো লোকেশন)।বিশেষ করে হোটেলের দোতলার ঘর আর সামনের খোলা ছাদ, যেখান থেকে নীলগিরি পাহাড় প্রায় হাত বাড়িয়েই ছুঁয়ে ফেলা যায়।হোটেলের খাওয়া ভালোই।ঘরের ভাড়াও বেশ কম।AC রুম 1000 থেকে 1200 টাকা।ফোনে যোগাযোগ করে ,50 পার্সেন্ট এডভান্স করে ,ঘর বুক করা যায়।

            340 বছর বয়সের তরুণ বৃক্ষ,যা সিমলিপাল জঙ্গলের মধ্যে প্রাচীনতম বলে মনে করা হয়(গাইড বলেছেন)

বিকালের রোদ কমে যাওয়ার আগেই চলে গেলাম,7km দূরে অবস্থিত খুমকূট ড্যাম দেখতে।যাওয়ার রাস্তাটি বেশ সরু হলেও,ওখানে পৌঁছে পাহাড়ের রূপ ,জলাধার আর ছোট ছোট আদিবাসী শিশুদের দেখে আমি মোহিত হয়ে পড়লাম।ওখান থেকে ফিরে হোটেলে গাড়ি পার্ক করে পায়ে হেঁটে চললাম পঞ্চলিঙ্গেশ্বর মন্দিরের পথে। জানতাম,কোভিডের কারণে মন্দিরে প্রবেশ নিষিদ্ধ, তবুও মন্দিরের সিঁড়ি অবধি ঐ চড়াই রাস্তাটুকু হাঁটতে আমার ভীষণ ভালো লাগে!



সৌভাগ্যবশতঃ আমাদের হোটেলের দোতলায় ঐ দিন আর কোনো বোর্ডার ছিলো না।এইকারণে আমরা সকলে মিলে, হোটেলের ঘরের সামনের বিশাল খোলা ছাদে বসে বসে পূর্ণিমার রাতে নীলগিরি পাহাড়ের রূপ উপভোগ করার সুযোগ পেয়ে গিয়েছিলাম।

                                                                        উস্কি জলপ্রপাত

তৃতীয় দিন (01.11.20) ::
সকাল সকাল স্নান সেরে ভারী ব্রেকফাস্ট খেয়ে চেক আউট করলাম, সকাল আটটা নাগাদ।আজ কুলডিহা ফরেস্ট খুলে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।গিয়ে যা দেখলাম,তা দেখে নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারলাম না।কুলডিহা ফরেস্টের মেন এন্ট্রি পয়েন্ট ফুল,বেলুন দিয়ে সাজানো হয়েছে,আর আজ একটু পরেই জঙ্গলের দরজা সাধারণ দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত করা হবে।আর দীর্ঘ কয়েকমাস পরে, আমরাই হবো প্রথম পর্যটক।

                                                                      বরেহিপানি জলপ্রপাত

গাড়ি থেকে নেমে,কুলডিহা ফরেস্ট গার্ডদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম, এখানে জঙ্গল সাফারী করতে হলে নীলগিরিতে অবস্থিত ফরেস্ট অফিস থেকে পারমিট সংগ্রহ করে আনতে হবে।এখন পারমিট করতে আবার ফিরে যাওয়ার অর্থ হলো, প্রচুর সময় নষ্ট।অগত্যা, ওনাদের কাছে প্রবেশের অনুমতির জন্য অনুরোধ করে বসলাম।ওনারা বললেন,একজন আধিকারিক নীলগিরি থেকে এখনই বের হবেন,আমরা তথ্য দিলে উনি ফোন করে তাঁকে পারমিট নিয়ে আসতে বলবেন।আমরা যেন হাতে চাঁদ পেলাম।

                                                        সিমলিপালের যোশিপুর এন্ট্রি পয়েন্ট

যতক্ষন না আমাদের পারমিট চলে আসছে, ততক্ষণ,আমরা খুব কাছেই অবস্থিত, রিসিয়া ড্যাম ঘুরে দেখে আসতে পারি।আমরা চললাম রিসিয়া ড্যাম দেখতে।জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে বন্ধুর,সরু,পাথুরে পথে যখন রিসিয়া ড্যাম পৌঁছালাম,তখন সূর্য মামা চোখ রাঙাতে শুরু করেছে।রিসিয়া ড্যাম দেখে চোখ জুড়িয়ে গেলো।দূরে পাহাড়ের সারি, আর সামনে বিপুল জলরাশি।তার পাশে লাল মাটির আঁকা বাঁকা পথ চলে গিয়েছে,মন কেমন করার দেশে।সে এক অদ্ভুত সৌন্দর্য!


গাড়ি ঘুরিয়ে দ্রুত কুলডিহা ফিরে এসে দেখি পারমিট রেডি।আধিকারিকরা আমাদের সকলকে চন্দনের ফোঁটা দিয়ে,ফুল দিয়ে স্বাগত জানালেন।ছিলো মিডিয়ার রিপোর্টাররা,আর গুটিকয়েক পর্যটক আর বন দপ্তরের আধিকারিকরা।
জঙ্গলে প্রবেশ করেই গেলাম,রিসিয়া নেচার ক্যাম্প।যেখানে টেন্টে,নিশিযাপনের সুন্দর ব্যবস্থা আছে।অনলাইনে বুক করে, এখানে রাতের জঙ্গলের স্বাদ চেখে দেখতে পারেন।
নিজেদের গাড়িতে জঙ্গল সাফারী করার মধ্যে একটা অদ্ভুত রোমাঞ্চকর, গা ছমছমে ব্যাপার আছে।আর দীর্ঘ কয়েকমাস জঙ্গল বন্ধ থাকায়,জঙ্গল যেন আরও বন্য রূপ ধারণ করেছিলো।শুকনো পাতার উপর দিয়ে যখন গাড়ির চাকা গড়িয়ে যাচ্ছিলো, তখন তার শব্দে এক অজানা ভয়ে শিহরিত হয়েছি বারেবারে।বিভিন্ন নাম না জানা পাখিরা,খুব মিষ্টি সুরে, আমাদের বন্ধু হওয়ার আমন্ত্রণ জানাচ্ছিলো।মাঝে এক জায়গায় একটা ওয়াচ টাওয়ার করা আছে।একটা ফরেস্ট অফিসও দেখলাম গভীর জঙ্গলে মাঝে। কোনো বড় পশুরা আমাদের দেখা দিতে রাজী হয়নি,তাই কিছুটা দুঃখ পেলেও,অসাধারন অভিজ্ঞতা নিয়ে একসময় সাফারী শেষ করে,জঙ্গল থেকে বেরিয়ে পড়লাম,বাংরিপোসির পথে।বাইরে আসার সময় ফরেস্ট গার্ডদের থেকে আরও একটা সুখবর জানতে পারলাম,ঐদিন সিমলিপাল জঙ্গলও পর্যটকদের জন্য খুলে দেওয়া হচ্ছে।
একটা কথা মনে রাখবেন, জঙ্গল সাফারিতে যাওয়ার পূর্বে,পর্যাপ্ত পানীয় জল অবশ্যই গাড়িতে রাখবেন।জঙ্গলে ধূমপান,মদ্যপান,পশুপাখিদের খাবার দেওয়া,বিরক্ত করা,হর্ন বাজানো,জোরে শব্দ করা,মাছ-মাংস খাওয়া,প্লাস্টিক ব্যবহার করা ইত্যাদি কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ।
যাওয়ার পথে দেবকুন্ড ঘুরে যাওয়ার ইচ্ছা ছিলো।কিন্তু,ঘড়ির কাঁটা বললো,দেবকুণ্ডের অনেকখানি হাঁটা পথ পেরিয়ে, আবার বাংরিপোসির হোটেলে পৌঁছাতে, অনেকটা দেরি হয়ে যাবে।ওদিকে দেবকুন্ড প্রবেশ করতে হলে দুপুর 3 টের আগেই প্রবেশ করতে হয়।তাই দেবকুন্ড যাওয়ার চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে হলো।পথে, একটা ভালো ধাবায় দেশি মুরগীর মাংস সহযোগে মধ্যাহ্নভোজন সেরে নিয়ে চলে এলাম,বাংরিপোসীর সেরা রিসর্ট ,"সিমলিপাল খইরি রিসর্টে"।
রিসর্টের একতলার AC ঘরের ভাড়া 1500 টাকা,নন AC ঘর 1000 টাকা।ফোনে কথা বলে অগ্রীম পাঠালে বুকিং হয়ে যায়।খাবার-দাবার অসাধারণ, রুম বেশ বড়,আর রিসর্টের পরিবেশ খুবই মনোরম। রিসর্টের ম্যানেজারের সাথে কথা বলে,পরের দিনের সিমলিপাল জঙ্গল সাফারী করার জন্য, একটা Bolero গাড়ি বুক করলাম।গাড়ি সকাল সাতটায় আসবে,আবার জঙ্গল সাফারী সেরে আমাদের হোটেলে পৌঁছে দেবে সন্ধ্যা 7 টায়,নেবে 4200 টাকা।এখানে দুটো প্রয়োজনীয় কথা বলা দরকার।প্রথমতঃ, গাড়ির গ্রাউন্ড ক্লিয়ারেন্স ভালো না হলে ,সিমলিপাল সাফারী করার অনুমতি পাওয়া যায় না।এখানে বড় গাড়ি (সুমো, বোলেরো, XUV)ছাড়া না যাওয়াই উচিত।
দ্বিতীয়ত,জঙ্গলে ঢোকার দুটি এন্ট্রি পয়েন্ট আছে,একটা বারিপাদা হয়ে ,আর অপরটি যোশিপুর হয়ে।আমরা যোশিপুর হয়েই যাবো ঠিক করলাম।
বাংরীপোসির আসে পাশে অনেক সুন্দর সুন্দর দেখার জায়গা আছে, যেমন,দেবকুন্ড জলপ্রপাত, সীতাকুন্ড,লুলুং নদী, পলপলা ড্যাম,শঙ্কারমারা ড্যাম,মা,দুয়ারসিনি মন্দির,সুলাইপাত ড্যাম,বাঁকিবল ড্যাম,বিসোই হাট,বুড়িবালাম নদী, ব্রাহ্মণকুন্ড,কান্দিহারা ঝরনা, বাদামঘাটি, নেদাম ড্যাম ইত্যাদি ইত্যাদি।যদিও এবার আমরা এগুলোর কোনোটাই ট্যুর প্ল্যানে রাখি নি।আমরা শুধুই সিমলিপাল জঙ্গল সাফারী করেই নিজেদের তৃপ্ত করবো,আর বাকি খিদেটা জমিয়ে রাখবো,পরের বারের জন্য।

চতুর্থ দিন (02.11.20) ::
ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠেই স্নান সেরে,ফ্রেশ হয়ে তৈরি হয়ে নিলাম।ভাড়া করা বোলেরো গাড়ি চেপে প্রথমে "বিসোই"তে এসে ব্রেকফাস্ট সারলাম।যোশিপুর এসেও ব্রেকফাস্ট করা যেতে পারে।চেষ্টা করবেন খুব ভোরে বেরিয়ে পড়তে।যোশিপুর থেকে ভোর 6am থেকে 9am পর্যন্ত জঙ্গল সাফারীর পারমিট ইস্যু করা হয়।এখান থেকে,শুধুমাত্র 35টি গাড়িকেই আগে আসার অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে ছাড়পত্র দেওয়া হয়।(বারিপাদা থেকে 25 টি গাড়ির প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়।)
হোটেল থেকে বেরিয়েই পাহাড়ের চড়াই শুরু হয়েছিলো।পথে দেখলাম, হনুমানের দল সপরিবারে দল বেঁধে জনসভা বসিয়েছে।পথের ডানদিকে পড়বে মা দুয়ারসিনি মন্দির। পথের দুই ধারের শোভা অপরূপ।
যোশিপুর এসে পারমিট করিয়ে,গাইড বুক করে(গাইড 300 টাকা),জঙ্গলের ভিতরে লাঞ্চ বুক করার জন্য মাথাপিছু 100 টাকা,গাড়ির এবং জনপ্রতি ধার্য টাকা জমা করলাম।এখানে উল্লেখযোগ্য হলো,রেজিস্টার্ড গাইড ছাড়া জঙ্গলে প্রবেশ করা যায় না।আর পারমিটের জন্য আধার কার্ড প্রয়োজন হয়।
যাই হোক,এই সব কাজ সেরে,বৈধ ছাড়পত্র সংগ্রহ করে, আমরা চললাম জঙ্গলের ভিতরে।
সিমলিপাল জঙ্গল বিশাল এলাকা জুড়ে অবস্থিত।গাইডের কাছে জানতে পারলাম,একদিনে সিমলিপাল সম্পূর্ণ ঘুরে দেখা সম্ভব নয়।সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত,আমরা যা যা দেখবো তা সমগ্র সিমলিপালের একটা অংশ মাত্র।পুরো দেখতে হলে অন্ততঃ 3 দিন সাফারী করতেই হবে।
সিমলিপাল জঙ্গলের মধ্যেই বেশ কিছু গ্রাম আছে যেখানে আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ বাস করেন।যদিও সরকার তাদের আর্থিক প্যাকেজ দিয়ে সরিয়ে দেবার চেষ্টা করছেন।জঙ্গলের পথ বেশিভাগটাই পাহাড়ী।উঁচু উঁচু পাথুরে,পাহাড়ি পথ,মাঝে মাঝে উপত্যকা,কোথাও ছোট আদিবাসী গ্রাম,কোথাও বয়ে চলেছে নদী, ঝরণার ধারা।
জঙ্গল এক এক জায়গায় ,এক এক ধরণের।মোট কথায়, এখানে প্রকৃতিদেবী নিজের রূপচর্চায় কোনো ত্রুটি রাখেননি।এখানে দেখতে পাবেন,বেহেরিপানি জলপ্রপাত, যা ভারতবর্ষের দ্বিতীয় উচ্চতম জলপ্রপাত।উস্কি জলপ্রপাত, জোরান্ডা জলপ্রপাত,চাহালা ভিউ পয়েন্ট,লুলুং নদী, খইরি নদী ইত্যাদি।জঙ্গলে আছে,বিভিন্ন প্রজাতির হরিণ,হাতি,বাঘ,ময়ূর সহ বিভিন্ন পশু ও পাখি।
খইরি নদীর গা ঘেঁষে এগিয়ে গেলেই,এন্ট্রি পয়েন্ট।জঙ্গলে প্রবেশ করার একটু পরেই গাইড সাহেব গাড়ি দাঁড় করিয়ে নামতে বললেন।আমরা দেখলাম,সিমলিপাল জঙ্গলের সবথেকে প্রাচীন বৃদ্ধ সতেজ গাছটিকে।তাঁর মুখ থেকে শুনলাম গাছটি নিয়ে প্রচলিত কিছু মিথ,গল্প গাথা।
গাড়ি এগিয়ে চললো উপত্যকা,নদীর সাঁকো পেরিয়ে পাহাড়ি বন্য পথে।
এবার এলাম উস্কি জলপ্রপাত দেখতে।প্রবল জলরাশি অবিরাম ধারায় ঝরে পড়ছে পাথরের বুক চিরে,পাথরের বুকে।এ জলধারার কোনো বিরাম নেই,নেই কোন ক্লান্তি।শুধুই সময়ের স্রোতের মতই বয়ে যাওয়া,পিছিয়ে আসার অবকাশ নেই।
এরপর জঙ্গল,গ্রাম,আবার জঙ্গল,কখনো চড়াই পথে উপরে উঠছি,কখনো নীচে নেমেছি।আর হ্যাঁ, মাঝ পথে কিছু চাষের জমিও দেখেছি।এখানে বন্য জন্তু আর আদিবাসী মানুষ নিজেদের এলাকা যেন খুব সুন্দর দলিল পত্র করে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগী করে নিয়েছে।কেউ কাউকে অযথা হয়রানী করতে চায় না।
একজায়গায় এসে দেখি এখানেও বন দপ্তরের থাকার ব্যবস্থা (নেচার ক্যাম্প)আছে।এর ঠিক সামনেই আমাদের দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা রেডি হয়ে আছে।সকালে এন্ট্রি পয়েন্টে যখন লাঞ্চ বুক করেছিলাম,তখনই ওয়ারলেসের মাধ্যমে এখানে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিলো।যাক, গরম গরম ভাত,সুস্বাদু ডাল, সবজি,তরকারী, ভাজা,মিনারেল ওয়াটারের বোতল, আমাদের কাছে বেশ রাজকীয় মনে হলো।
এবার এগিয়ে চললাম,সুউচ্চ জলপ্রপাত(ভারতের দ্বিতীয় উচ্চতম)বরেহিপানি জলপ্রপাত দেখতে।উফফ্,এর সৌন্দর্য বর্ণনা করার ভাষা আমার জানা নেই।আমার মোবাইলের 48 মেগাপিক্সেল ক্যামেরায় এর রূপ বন্দী করা অসম্ভব।এটা এখানে এসে,নিজের চোখে দেখাই ভালো।মূল ভিউ পয়েন্ট থেকে সরে,জঙ্গলের এক জায়গায় নিয়ে গেলেন গাইড সাহেব।গিয়ে একটা অদ্ভুত জিনিস প্রত্যক্ষ করলাম।জলপ্রপাতের জলে সূর্যের আলো পড়ে, রামধনুর সৃষ্টি হয়েছে।যদিও আমার মোবাইলের দুর্বল zoom সেটাকে ফ্রেমবন্দি করতেই পারলো না।ওখান থেকে আসতেই ইচ্ছা করছিলো না।গাইড সাহেব একটা গাছে একটু ঝাঁকা দিতেই,ঝুপঝুপ করে কাঁচা আমলকী ঝরে পড়লো।কুড়িয়ে নিয়ে তার অম্ল মধুর স্বাদ চেখে দেখলাম।
এদিকে বেলা পড়ে আসছে।এরপর জোরান্ডা জলপ্রপাত দেখার পালা।গাইড সাহেব বললেন,জোরান্ডা আর কোর এরিয়ার বন্য জন্তু দেখা,এই দুটোর মধ্যে যেকোনো একটা বেছে নিতে।কারণ দুটো দুইদিকে,আর দূরত্ব অনেক।আমরা ঠিক করলাম,কোর এরিয়াতেই যাবো।সুতরাং গাড়ি ছুটলো,বন্য জন্তুদের আস্তানায়।

বরেহিপানি জলপ্রপাত দেখে একরাশ প্রশান্তি নিয়ে বেরিয়েছিলাম।বন্য জন্তু দেখার জন্য জঙ্গলের কোর এরিয়াতে প্রবেশ করতে হলো।দুই দিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে আমাদের গাড়ি চলছিলো, যতটা সম্ভব কম শব্দ করে।জঙ্গলের ভিতরে একটা ফরেস্ট গার্ডদের থাকার জায়গায় গিয়ে একটু দাঁড়ালাম।একটা পরিত্যক্ত ওয়াচ টাওয়ার মতো কিছু একটা ছিল,ওতেই ওঠার চেষ্টা করছিলাম।ওদের কাছে শুনলাম পূর্ণিমার রাতে বাঘ বেরিয়েছিলো।কিন্তু,বাঘের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার সৌভাগ্য আমাদের হয়নি।আবার এগিয়ে চললাম।অনেকটা যাওয়ার পর কয়েকটি কালো মিশমিশে ,পাহাড় প্রমান হাতিকে জঙ্গলের মধ্যে ডালপালা ভাঙতে দেখলাম।যদিও গাড়িতে বসে বসে,ছবি ঠিক মতো তুলতে পারলাম না।খালি গাছপাতাই আসছিল ছবিতে,প্রাণীদের দেহের সামান্য অংশই দেখা যাচ্ছিলো, পুরো দেহকে ফ্রেমবন্দি করতে পারিনি একটি ছবিতেও।
এদিকে খুব তাড়াতাড়ি সন্ধ্যা নেমে এসে আলিঙ্গন করছিলো সমগ্র জঙ্গলকে।আমরা দ্রুত পৌঁছালাম,চাহালা ওয়াচ পয়েন্টে।এখানে জঙ্গলের একটা অংশ পরিষ্কার করে,বিস্তীর্ণ তৃণভূমি করা হয়েছে,আর একটা Saltlick point করা হয়েছে।বন্যপ্রাণীরা সন্ধ্যায় এখানে চেটে চেটে শরীরের মিনারেল সংগ্রহ করতে আসে।দূরের আড়ালে থাকা ওয়াচ টাওয়ার থেকে তা দেখা যায়।আমরা একটু অপেক্ষা করলাম।একে একে, বাইসন জাতীয় কোনো প্রাণী আর পাল পাল হরিণ আসতে দেখলাম।কিন্তু,সেসব বেশ খানিকটা দূরে আর আলো কমে যাওয়ায় ছবি একদম ঝাপসা হয়ে গেলো।
সারাদিনের ভালো লাগার উপরে, অনেকটা জার্নির শারীরিক ধকল প্রভাব ফেলতে থাকলো।এদিকে ঝপ করে অন্ধকার নেমে এলো।আমরা জঙ্গল ছেড়ে,আসতে বাধ্য হলাম।গাড়ির হেড লাইট জ্বালিয়ে,শেষ এক্সিট পয়েন্ট পেরিয়ে যখন হাইরোডে উঠলাম,তখন গা ছমছমে ভাবটা কিছুটা কাটলেও সমগ্র শরীরে লেপ্টে ছিলো একরাশ ভালো লাগা। বাংরিপোসির খইরি রিসর্টে ফেরার পথে শুধুই চোখের সামনে ভাসছিলো, সারাদিন দেখা সমস্ত দৃশ্যগুলো।তখনই মনে মনে ভাবছিলাম,সিমলিপালে ভবিষ্যতে আবার আসতেই হবে।হোটেলে ফিরতে রাত আটটা বেজে গিয়েছিলো।এসেই ডিনার সেরে ঘুমিয়ে পড়ি।
পঞ্চম দিন (03.11.20):
পরেরদিন অর্থাৎ বাড়ি ফেরার দিন,ভোরবেলা উঠেই ঠিক করলাম,5am থেকে 8am এই তিন ঘন্টায় সুলাইপাত ড্যাম আর বাঁকিবল ড্যাম ঘুরে দেখবো।কিন্তু,শেষ মুহূর্তে মত বদলিয়ে ঘুরে এলাম কিছু,নাম না জানা আদিবাসী গ্রামে।যেখানে আদিবাসী গ্রামবাসীরা আড়মোড়া ভেঙে,দৈনন্দিন কাজে নিজেদের নিয়োজিত করতে শুরু করেছিল।
হোটেলে ফিরেই ঝট করে,স্নান আর ভারী ব্রেকফাস্ট সেরে নিয়ে,ঠিক 9টায় চেক আউট করলাম।
তবে এখনই বাড়ি ফিরতে মন চাইলো না।ঠিক করলাম একটু ঘুরে ঘুরে বাড়ি ফিরবো।গুগুল ম্যাপ ঘেঁটে প্রথমে হাতিবাড়ি,তারপর গোপীবল্লভপুর,এরপর লোধাশূলির জঙ্গল পেরিয়ে চলে গেলাম ঝাড়গ্রাম।ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ী দেখে,চলে গেলাম কনক দুর্গা মন্দির।এরপর গাড়ি মুম্বাই রোড ধরে এক ছুটে সোজা কোলাঘাটের শের-ই-পাঞ্জাব।এরপর একরাশ পেট পূজা সেরে,বাইরে বেরিয়ে একটা মিষ্টি পান চিবিয়ে সার্থক বাঙ্গালীবাবুর মতই বাড়ি ফিরলাম সন্ধ্যায়।।
কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য:
সিমলিপাল জঙ্গলে নাইট স্টে করার জন্য, বন বিভাগের 5টি ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় 5টি নেচার ক্যাম্প আছে,যা অনলাইনে বুক করা যায়।
বর্ষাকাল বন্যপ্রাণীদের মেটিং সিজিন,তাই বর্ষাকালে সমস্ত জঙ্গল পর্যটকদের জন্য বন্ধ থাকে।
দূরত্ব:
মোট 4 রাত,5 দিনের ট্যুরে আমরা প্রায় 1100 km মতো জার্নি করেছি।রাস্তা 95%মাখনের মতো মসৃন আর ফাঁকা।গুগুল ম্যাপের সাহায্য নিয়ে সব রাস্তার তথ্য পাবেন।তবুও,কিছু,বলি,
1.কলকাতা থেকে চাঁদিপুর বীচ প্রায় 260km
2.চাঁদিপুর থেকে পঞ্চলিঙ্গেশ্বর 39km
3.পঞ্চলিঙ্গেশ্বর থেকে খুমকূট ড্যাম 7km
4.পঞ্চলিঙ্গেশ্বর থেকে কুলডিহা ফরেস্ট এন্ট্রি 32km
5. কুলডিহা থেকে দেবকুন্ড 30km
6.বাংরিপোসি থেকে যোশিপুর 62km
ফোন নাম্বার:
১. গোবিন্দ যাত্রী নিবাস,পঞ্চলিঙ্গেশ্বর, নীলগিরি:
8895983671
8847849231
২. সিমলিপাল খইরি রিসর্ট,বাংরিপোসি,ময়ূরভঞ্জ:
09437877730
08249002656
06791223292
৩. OTDC এর পান্থনিবাস বুক করতে দেখুন:
৪. সিমলিপাল জঙ্গলের ভিতরের নেচার ক্যাম্পে থাকতে হলে,বুকিং করতে হবে নিচের ওয়েবসাইটে,
সকলে ভালো থাকুন,সুস্থ থাকুন।আর প্রচুর ভ্রমণ করুন।
ধন্যবাদ
সুমিত কুমার ঘোষ

0 comments:

Post a Comment