Sunday, March 24, 2019

বালাসোর (বালেশ্বর) ও চাঁদিপুর - Balasore or Baleshwar and Chandipur

 এক লম্বা ড্রাইভে উড়িষ্যার বালেশ্বর ও চাঁদিপুরে:-

সেদিন হঠাৎ বসেছিলাম উড়িষ্যার ম্যাপ নিয়ে। ম্যাপ বলতে গুগলের ম্যাপ। আজকাল কোথাও যাবার কথা ভাবলেই প্রথমেই খুলে বসি, "গুগল ম্যাপ"। সেদিন ম্যাপে দেখতে বসেছিলাম, উড়িষ্যার বালাসোরের (বালেশ্বর) ও চাঁদিপুরের লোকেশন এবং যাবার রাস্তার যাবতীয় তথ্য। ইচ্ছে ছিল একটা লং ড্রাইভে যাওয়ার। কিন্তু শুধুমাত্র যাবার ইচ্ছে থাকলেই তো হয়না; কোথাও যাবার আগে সেই জায়গা এবং তার আশেপাশের দর্শনীয় জায়গাগুলোর আদ্যপান্ত জানার দরকার।
Sea beach, Chandipur
                                                        Sea beach, Chandipur

অবশ্য এই স্বভাব, আমার বহুবছরের, বোধহয় পেশাদারিত্বের তাগিদে। সেদিন চাঁদিপুর এবং তার আশেপাশের দর্শনীয় স্থানগুলোর বিস্তারিত বিবরণ দেখার পর, চাঁদিপুর সমুদ্র সৈকতের উপর, উড়িষ্যা ট্যুরিজম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের পান্থনিবাসে থাকাই মনস্থ করলাম। একেইতো চাঁদিপুরে সবচেয়ে ভালো লোকেশনে ওই পান্থনিবাস। তার উপরে প্রবীণ নাগরিকদের জন্য ভাড়ায় একটা ছাড় রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে কম্প্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্ট। অবশ্য কম্প্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্টের চল, আজকাল ভারতের সমস্ত বাজেট এবং স্টার হোটেলগুলোতে চালু হয়েছে। অতএব একদিন ইন্টারনেটে উড়িষ্যা ট্যুরিজম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের ওয়েবসাইট থেকে পান্থনিবাসের একটা ঘরের বুকিং করে ফেললাম।

Concrete area of Panthanivas on the sea beach, Chandipur.
                                  Concrete area of Panthanivas on the sea beach, Chandipur

------ ২ ------
গত বছরের আঠেরোই জানুয়ারির (১৮-০১-২০১৯) সকালে, গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম উড়িষ্যার চাঁদিপুরের উদ্দেশ্যে। দক্ষিণেশ্বরের নিবেদিতা সেতুর টোলগেট পার করে উঠেছিলাম ষোলো নম্বর জাতীয় সড়কে। কোলাঘাট, ডেবরা পার হয়ে খড়গপুর চৌরঙ্গীমোড় থেকে তিন কিলোমিটার আগে, বাঁহাতে বাঁক নিয়েছে এন.এইচ.১৬। আবার ওই মোড় থেকে শুরু হয়েছে এন.এইচ ৪৯ যে রাস্তা ওখান থেকে শুরু হয়ে, লোধাশুলী, বাহারাগরা হয়ে কেওনঝড়ে গিয়েছে। এন.এইচ.১৬ ওই মোড় থেকে ডেবরা, দাঁতনের উপর দিয়ে, সোজা উড়িষ্যার জলেশ্বর পার হয়ে বালেশ্বরের উপর দিয়ে চলে গিয়েছে ভুবনেশ্বরের দিকে। একেবারে ঝাঁ-চকচকে রাস্তা। ট্রাফিক নেই বললেই চলে। এককথায় ড্রাইভিং করার স্বর্গ। আমি জলেশ্বরের টোলগেট পার হয়ে, সুবর্ণরেখা নদীর উপরের ব্রিজ পার করে এগিয়ে গেলাম বালেশ্বরের দিকে। বালেশ্বর শহরে ঢোকার চৌমাথার আগেই, রেলওয়ে ওভারব্রিজ পার হওয়ার পর, বাঁহাতে এগিয়ে চলেছে চাঁদিপুর যাবার রাস্তা। হাইওয়ে থেকে নীচে নেমে গেলাম, সার্ভিস রোড দিয়ে। ওটাই সবচেয়ে শর্টকাট রাস্তা, কলকাতা থেকে চাঁদিপুর যাবার জন্য। একটু এগোতেই পড়লো ইতিহাস প্রসিদ্ধ বুড়িবালাম নদীর সেতু। রাস্তা দেখলাম কখনও চলেছে বুড়িবালামের পাশাপাশি হাত ধরাধরি করে, আবার কখনও টা- টা-বাই-বাই জানিয়ে অনেক দুরে। আমি বালেশ্বর শহরের অনেক আগে থেকেই চাঁদিপুর যাবার রাস্তা ধরেছিলাম। বালেশ্বর শহর থেকে প্রায় পনেরো কিলোমিটার দূরে চাঁদিপুর। লোকালয় ছাড়িয়ে কিছুটা চলার পর, রাস্তার দুধারে শুরু হলো অনুর্বর রুক্ষ জমি। তার মধ্যেই লাগানো হয়েছে নারকেল, খেজুর এবং কলাগাছ। তবে কিছু কিছু জায়গায় রাস্তার ধারে ইতস্তত করছিল কৃষ্ণচূড়া আর রাধাচূড়া গাছ । চাঁদিপুর সমুদ্র সৈকতে পৌঁছনোর বেশ কিছু আগেই শুরু হলো, রাস্তার ধারে পাঁচিলে ঘেরা কমপাউন্ড, শেষ আর হয়না। বুঝলাম ওটাই হলো চাঁদিপুরে অবস্থিত ভারতের প্রতিরক্ষা গবেষণা ও উন্নয়ন সংগঠনের ( Defence Research and Development Organisation) কমপাউন্ড। অবশ্য ভারতের সমস্ত ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করা হয় আব্দুল কালাম দ্বীপ থেকে। দ্বীপটি চাঁদিপুর সমুদ্র উপকূল থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত।
The bank of Buribalam river.
                                                        The bank of Buribalam river

পান্থনিবাসে যাবার পথে বেশ কয়েকটি হোটেল দেখলাম সমুদ্র সৈকতের কাছেই; পাশাপাশি। দেখতে দেখতে পৌঁছলাম আমাদের গন্তব্যস্থল চাঁদিপুরের পান্থনিবাসে । দক্ষিণেশ্বরের নিবেদিতা সেতু থেকে ২৬১ কিলোমিটার। আমার বাড়ি থেকে ঠিক ২৬৪ কিলোমিটার। সকাল সাতটায় বেরিয়েছিলাম। পৌঁছাতে পৌঁছাতে ঘড়িতে বাজল দুপুর একটা‌। অবশ্য রাস্তায় বেশ কয়েকটি জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিলাম, চা, জলখাবারের জন্যে। পান্থনিবাসে পৌঁছে দেখলাম, কমপাউন্ডের চারিদিকে উচুঁ পাঁচিলে ঘেরা। প্রথমেই ঢোকার গেট। গেটের ভেতরে গাড়ি ঢোকানোর আগে, রিজার্ভেশনের কাগজ দেখতে চাইল। ভালই লাগল সুরক্ষার ব্যবস্থাপনা দেখে। এতটা ড্রাইভ করে আসার পর, পেটের ভিতরে ছুঁচোর ডন মারা শুরু হয়ে গিয়েছিল। রিসেপশনের ফর্ম্যালিটি মিটিয়ে, ওখানেই লাঞ্চের অর্ডার দিয়ে, আমাদের জন্য নির্দিষ্ট ঘরটি দখল করলাম; তারপর সোজা হোটেলের ডাইনিং হলে। হলটা বেশ বড়। একসঙ্গে তিরিশ চল্লিশজন লোকের খাবার খাওয়ানোর ব্যবস্থাপনা রয়েছে।
Nilgiri Palace
                                                                      Nilgiri Palace

------------ ৩ ----------
মধ্যাহ্ন ভোজন পর্ব শেষ করে, পান্থনিবাসের ভেতরে এক রাউন্ড চক্কর মারলাম দুজনে। বিশাল কমপাউন্ড; কিন্তু বাইরে থেকে বোঝাই যায়না। হোটেলের আকৃতিটা অদ্ভুত রকমের গোলাকার। আমি আমার জীবনে বিভিন্ন হোটেলে থেকেছি, কিন্তু এরকম গোল হোটেল আমি এর আগে কখনও দেখিনি । আমাদের ঘরটা দেখলাম সামনের দিকে। ঘর থেকেই সমুদ্র সৈকত দেখা যাচ্ছিল। ভেতরে আর একটা গোলাকৃতি কমপ্লেক্স। সেই কমপ্লেক্সের সামনে হোটেলের একটা বেশ বড় মাঠ আছে, যেখানে দোলনা, স্লিপ ইত্যাদি আছে। এমনকি ব্যাডমিন্টন খেলার কোর্ট। এছাড়া কিছু ফুলের গাছও আছে । নানান রকমের পাখি রয়েছে খাচায়। সবমিলিয়ে একটা শান্ত নিরিবিলি আর পরিচ্ছন্ন ভাব; যেটা একটা জায়গাকে ভাল লাগার জন্য যথেষ্ট উপযোগী। সবথেকে আকর্ষণীয় ব্যাপার হল সমুদ্রের নৈকট্য । ওই অংশে সমুদ্র সৈকতটা(sea beach) এবং ওখানকার বসার জায়গা ইত্যাদি, পান্থনিবাসের নিজস্ব, ওখানে বাইরের কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয় না ।
Durga Mandir, Adjacent to Nilgiri Palace
                                            Durga Mandir, Adjacent to Nilgiri Palace

হোটেল কমপাউন্ডের পরেই শুরু হয়েছে সৈকত। হোটেলের রিসেপশনের সামনে লনে নিজস্ব বাগান আর একটা ছোট্ট জলাশয় আছে, সেখানে আবার কচ্ছপ রয়েছে। সমস্ত দেখার পর, একটু বিশ্রাম নিয়ে গেলাম সমুদ্রের ধারে। কিন্তু কোথায় সমুদ্র ? দিগন্তরেখা পর্যন্ত যতদূর চোখ যায় শুধু বালি আর বালি ! সেই বালি কিন্তু নরম বালি নয়, শক্ত ভিজে বালি । হ্যাঁ, এটাই চাঁদিপুরের প্রধান আকর্ষণ । এখানে ভাঁটার সময়ে সমুদ্র, তীর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে চলে যায় । সমুদ্রতীর থেকে জলের রেখা দেখাও যায় না । জোয়ার ভাঁটার মধ্যে এই বিশাল পার্থক্যটা সারা ভারতবর্ষে একমাত্র গুজরাটের ভাবনগরের কলিয়াক সমুদ্র সৈকত ছাড়া আর কোথাও আছে বলে আমার জানা নেই। ঘড়িতে দেখলাম বিকেল চারটে বেজেছে, সূর্য ক্রমশঃ দিগন্তের দিকে ঢলে পড়ছে, এর পরে আর বিচে হাঁটা যাবে না, তাই আমি জলের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। গিন্নি বেঞ্চের উপর বসে রইল।

Nilgiri Palace and Nilgiri Hill
                                                    Nilgiri Palace and Nilgiri Hill

কিন্তু পাঁচ কিলোমিটার শক্ত বালির ওপর হেঁটে চলা সহজ নয়, আর মাঝে মাঝে গোড়ালি ডোবানো জমা জল, কাজটাকে আরও কঠিন করে দেয়। প্রায় এক-দেড় কিলোমিটারের মতো এগিয়ে ফিরে এলাম । হোটেলের পাশেই সমুদ্রের সৈকত ধরে রয়েছে ঝাউবন; ওদিকে এগিয়ে গিয়ে দেখলাম, ঝাউ বনে হাওয়া ঢুকে খেলা করছে। সিমেন্টে বাঁধানো রাস্তার ঠিক নীচেই রয়েছে বালি। কয়েকটি কুচো বাচ্চা বালিতে নাম লিখছে, কিন্তু ঢেউ এসে মুছিয়ে দিচ্ছে না, অন্যান্য সমুদ্র সৈকতের মতো; কারন জল বা ঢেউ নেই ওখানে। একটু এগিয়েই বোল্ডার। চাঁদিপুরের সৈকতে খালি পায়ে হাঁটা যায় না। গোটা সৈকত জুড়েই ছড়িয়ে রয়েছে গুঁড়ো গুঁড়ো শামুক, ঝিনুক। মৃত রাজকাঁকড়ার খোলসও ছড়িয়ে রয়েছে ইতিউতি। আসলে এখনও মানুষ এসব জায়গায় পা রাখেনি তেমন। তাই ঝিনুক কুড়ানো যায় প্রাণ ভরে। হাঁটলেই পায়ের নীচে মড়মড় শব্দ তুলে গুঁড়িয়ে যায় ঝিনুক।

Foothill of Nilgiri( Pancha lingeswar)
                                                   Foothill of Nilgiri( Pancha lingeswar)

--------- ৪ ------------
সমুদ্রের তীরেই ঘোরাঘুরি করছিলাম দুজনে। কখনো পায়চারি, আবার কখনো একটু বসে জিরিয়ে নেওয়া। পান্থনিবাস একেবারে সমুদ্রের ধারেই। পান্থনিবাসের ঠিক সামনেই সমুদ্রের বিচের উপরে অনেকখানা জায়গা জুড়ে সাজানো রয়েছে বসার বেঞ্চ, কারুকাজ করা আলোকস্তম্ভ। লাইন দিয়ে রয়েছে হস্তশিল্পের দোকান, বিক্রি হচ্ছে চাউমিন এবং এগরোল। কিন্তু বাঁধানো বসার জায়গায় যা আলো আছে, তা সৈকতে পৌঁছায় না। অন্ধকার সমুদ্র, অনেক অনেক দূরে জেলেদের নৌকার টিমটিমে আলো। সমুদ্র এখানে গুটি গুটি পায়ে বেলাভূমিতে ফেনার নূপুর পরিয়ে যায়। একাই পায়চারি করছিলাম এদিক ওদিক। হটাৎ দেখি, গিন্নি সৈকতে নেমে বালির উপর ঝিনুকের খোঁজে ব্যস্ত। দেখে ভাবলাম, "ওই সাগরবেলায় ঝিনুক খোঁজার ছলে, আরও একবার নিজের শৈশবে হারিয়ে যাওয়ার ঠিকানা বোধহয় ওড়িশার চাঁদিপুর"।
Jagannath temple at Ispat colony, Balgopalpur, Balasore.
                                    Jagannath temple at Ispat colony, Balgopalpur, Balasore.

আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, সূর্য অস্তাচলে যাবার জন্য তোড়জোড় শুরু করেছে। হটাৎ দেখি, ভীড় বাড়তে শুরু করেছে। বাইরের দিক থেকে পান্থনিবাসে ঢোকার প্রধান ফটকের পাশের ছোট্ট গেটটা দিয়ে, বাইরের লোক এসে, সমুদ্রের তীরে ভীড় জমিয়ে ফেলেছে। শুনলাম, বিকেল পাঁচটা থেকে জোয়ার শুরু হয়েছে। সন্ধ্যের পরেই সমুদ্রের জল তীর পর্যন্ত এসে যাবে। তাই এত ভীড়। অনেকেই সৈকতে নেমে জলের দিকে এগিয়ে চলেছে দেখলাম। আমিও হাঁটা শুরু করলাম ওদের পেছন পেছন। সত্যিই তাই। মাত্র দুশো মিটারও যেতে হলোনা, আধো অন্ধকারে দেখলাম সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ছে বেলাভূমিতে। দেখতে দেখতে চারিদিকে অন্ধকারের ঘনঘটা শুরু হয়ে গেল। বুকের ভেতরটা কেমন যেন একটু দুরুদুরু করা শুরু হয়েছিল, এই ভেবে যে সমুদ্রের জল যে কোনো মূহুর্তে আছড়ে পড়বে আমার উপর। আর দাঁড়িয়ে থাকলাম না, ঢেউয়ের আছড়ে পড়ার ওই দৃশ্য ক্যামেরা বন্দি করে দ্রুতগতিতে পা চালিয়ে দিলাম তীরের দিকে। রাতে ডিনারের পর আবার গিয়ে বসেছিলাম বীচের উপরে বেঞ্চের উপর কিছুক্ষণের জন্য। টিমটিমে আলো আর অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। কিন্তু ঢেউয়ের আওয়াজে বুঝতে পারলাম, সমুদ্রের জল তীরের কাছাকাছি এসে পৌঁছিয়েছে।
----------৫ -----------
পরদিন সকালে সূর্যোদয় দেখার সাথেই, সমুদ্রের সঙ্গে নিবিড় সখ্যতা তৈরি হয়ে গেল। তীরে জল ছিল না। কিন্তু সমস্ত রাত ধরে খেলা করে যাওয়া, জলের ঢেউয়ের ছাপ এবং জায়গায় জায়গায় জমে থাকা জল দেখে, বুঝতে কোনও অসুবিধা হলোনা, রাতে জলের উপস্থিতি উপলব্ধি করতে। সকালে ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়ে পরলাম চাঁদিপুরের আশেপাশে।চাঁদিপুর থেকে ঘণ্টাখানেকের দূরত্বেই বেশ কিছু ঘোরার জায়গা আছে। আমাদের প্রথম গন্তব্য ছিল বুড়িবালাম। পান্থনিবাস থেকে মাত্র দুই কিমি দূরে বুড়িবালাম নদীর তীর। স্থানীয় মানুষেরা চষাখণ্ড বলে থাকেন। ওখানেই বুড়িবালাম মিশেছে বঙ্গোপসাগরে। ওইখানে অগ্নিযুগের বীর বিপ্লবী বাঘাযতীন, অস্ত্রবোঝাই মেভারিক জাহাজ ধরা পড়বার পরেও, চার্লস টেগার্টের ব্রিটিশ বাহিনীর সঙ্গে এক অসম লড়াইয়ে প্রাণ হারিয়ে, লুটিয়ে পড়েন এই বুড়িবালামের তীরে। কিন্তু ঠিক কোথায় ওই লড়াই হয়েছিল, তার সঠিক সন্ধান কেউ দিতে পারলো না। ওইখানে নদীর জেটিতে পরপর দাঁড়িয়ে ছিল, মাছ ধরার ট্রলার। পাশেই মাছের পাইকারি বাজার। শুনলাম উড়িষ্যা সরকার বিপ্লবী বাঘাযতীনের স্মৃতিকে সম্মান জানিয়ে, বুড়িবালামের তীরে একটি পার্ক তৈরি করে, বাঘাযতীনের মূর্তি স্থাপন করেছে। মনটা একটু ভারাক্রান্ত হয়ে গেল, অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের কথা ভেবে।
---------- ৬ --------
বুড়িবালামের তীরে কিছুক্ষণ কাটিয়ে দুজনে রওয়ানা দিলাম নীলগিরি রাজবাড়ির দিকে। বালেশ্বর শহরের উপর দিয়ে, রেলওয়ে লেভেল ক্রসিং পার করে সোজা উঠলাম ষোলো নম্বর জাতীয় সড়কে। ওই সড়ক ধরে, ভুবনেশ্বরের দিকে কিছুটা যাবার পর শুরু হয় সিমলিপাল ফরেস্টে যাবার রাস্তা। উনিশ নম্বর রাজ্য সড়ক। রাস্তার একদিকে পাহাড়। ওই পাহাড়ের গায়েই নীলগিরি প্রাসাদ। চাদিপুরের পান্থনিবাস থেকে দুরত্ব তেত্রিশ কিলোমিটার। নীলগিরি আসলে ব্রিটিশ আমলের প্রিন্সলে স্টেট। ১১২৫ সালে ছোটনাগপুরের কোনও এক রাজা এসে এখানে ভিত্তিস্থাপন করেন। রাজপুত ঘরানার লোকই ছিল এখানের বাসিন্দা। স্বাধীনতা সংগ্রামীরা এই প্রিন্সলে স্টেটটিকে রাজাদের হাত থেকে ছিনিয়ে নেয়। পরে ভারত স্বাধীন হলে নীলগিরি আলাদা শহর রূপে গড়ে ওঠে। এখন ভাঙাচোরা এককালের রাজপ্রাসাদ। জীর্ণ সিংহদুয়ার। দেওয়ালে রাজপুতানা চিত্রশিল্পের ভগ্নাবশেষ দেখে বোঝা যায়, এককালে দাপটে চলত রাজত্ব। একটা অংশে যত্নআত্তি করে রঙ করা। তাতে লেখা ‘নিজাগড় প্যালেস'। প্যালেসের কিছুটা অংশ মেরামত করে এখনকার রাজা থাকেন। আর কিছুটা ভাগে রয়েছে একটি স্কুল। প্যালেসের পাশেই একটি দূর্গা মন্দির। রাজবাড়ির পাশেই আছে নীলাগিরি পাহাড়, যেটার একেবারে ওপরে না হলেও অনেকদূর পর্যন্ত ট্রেকিং করে ওঠা যায় ।
---------- ৭ ----------
নিজাগড়(নীলগিরি) প্যালেস থেকে বেরিয়ে গাড়ির স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে এগিয়ে গেলাম, আট কিলোমিটার দূরের পঞ্চলিঙ্গেশ্বর মন্দিরের দিকে। নীলগিরি পাহাড়ের উপরের পঞ্চলিঙ্গেশ্বর মন্দির বোধহয় চাঁদিপুর/বালাসোরের অন্যতম আকর্ষণীয় ঘোরার জায়গা। নীলগিরি পাহাড় মন্দিরটিকে চারিদিক দিয়ে আচ্ছাদিত করে রেখেছে। তিনশো পাঁচটি সিঁড়ি পেরিয়ে পাহাড়ের উপরে, ভগবান শিবের পাঁচটি শিবলিঙ্গে জন্য পঞ্চলিঙ্গেশ্বর জনপ্রিয়। সবচেয়ে আকর্ষণীয় হলো, শিবের লিঙ্গের পাশেই প্রবহমন ঝর্ণার উপস্থিতি। যদিও তিনশো পাঁচটি সিঁড়ি পেরিয়ে পঞ্চলিঙ্গেশ্বরে পৌঁছাতে হয় কিন্তু বাস্তবিক ক্ষেত্রে দেখলাম, সিঁড়িগুলো দিয়ে উপরে উঠতে খুব বেশী কষ্ট হয় না। মন্দির বলতে অনেকটা পাহাড়ের গায়ে গুহার মতো। প্রচুর আলতা সিঁদুর লাগানো দেওয়াল, মাথায় ধর্মীয় পতাকা উড়ছে। পাঁচটা শিবলিঙ্গ রয়েছে জলের ধারার ঠিক পাশেই। ভক্তরা জলের ধারার জল মাথায় ছিটিয়ে পুজোয় বসছে। অবশ্য প্রতিটি শিবলিঙ্গের সামনে পুরোহিত রয়েছে, যারা পূজা করার জন্য সাহায্য করছে। সবচেয়ে যেটা ভালো লাগলো, তা হলো, ওঠার সিড়িগুলোর ধাপের সঙ্গেই বসার ব্যবস্থা, ফলে ওঠার ফাঁকে প্রয়োজনে একটু জিরিয়ে নেওয়া যেতে পারে। আমরা দুজন গল্প করতে করতে এবং প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে উপরে উঠছিলাম। কিছু কিছু জায়গায় চারিদিকের নৈসর্গিক দৃশ্য দেখে চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছিল ।
-------- ৮ --------
পঞ্চলিঙ্গেশ্বর দেখার পর আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ছিল রেমুনা।
পঞ্চলিঙ্গেশ্বর থেকে দুরত্ব ঠিক তিরিশ কিলোমিটার। কিন্তু অনেক বেলা হয়ে গিয়েছিল, পাহাড়ের উপর থেকে নীচে নামতে। ফলে লাঞ্চ করার জন্য একটা ভালো রেস্টুরেন্ট খুঁজে বের করতে অনেকটুকু সময় পার হয়ে গেল। যাইহোক শেষপর্যন্ত একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে মুখের ভিতর খাবার ঢুকিয়ে রেমুনার উদ্দেশ্যে এগিয়ে গেলাম।
রেমুনায় বিখ্যাত "ক্ষীর চোরা গোপীনাথ" । কথিত আছে, চৈতন্য মহাপ্রভু এবং মাধবেন্দ্র পুরী, পুরীতে যাবার সময় রেমুনাতে বিশ্রাম নিয়ে পুরী যাত্রা করেন। নানান জনশ্রুতি রয়েছে চৈতন্য মহাপ্রভু এবং মাধবেন্দ্র পুরী এবং ক্ষীর চোরা গোপীনাথকে নিয়ে। বৈষ্ণব পদাবলী চৈতন্যদেব সম্পর্কে বলেছে, "রেমুণা তে গোপীনাথ পরমমোহন। ভক্তি করি কৈলা প্রভূ তাঁর দর্শন"। মন্দিরের গর্ভগৃহে রত্ন সিংহাসনে বসানো রয়েছে তিনটি কলেবর। মাঝখানে আছেন ক্ষীরচোরা গোপীনাথ, গোপীনাথের বাঁদিকে গোবিন্দ আর ডানদিকে মদনমোহন। শুনলাম মন্দিরে ভোরে মঙ্গলারতি থেকে রাত্রে বিশ্রাম অবধি ৮ বার আরতি হয়। বিখ্যাত ক্ষীরভোগ যাকে ‘অমৃতকেলি’ বলা হয় তা সন্ধ্যাবেলায় নিবেদন করা হয়। গোপীনাথ কে সপ্তাহে সাতদিনে সাত রঙের পোষাক পরানো হয়। দুপুরে নিবেদন করা হয় অন্নভোগ। ওই মন্দিরে শ্রী চৈতন্যদেবের পায়ের ছাপ রাখা আছে । ওখানকার সবথেকে বড় আকর্ষণ দেখলাম, সেটা হলো অত্যন্ত উৎকৃষ্ট মানের ক্ষীর। মন্দিরের ভেতরেই বিক্রি হচ্ছে; দামেও সস্তা। ২০ টাকা, ৩০ টাকা আর ৫০ টাকা। কিছু কিনে নেওয়া হলো, বাড়িতে নিয়ে আসার জন্য। মন্দির কমপ্লেক্সের ভিতরে নাটমন্দিরকে কেন্দ্র করে, দেওয়ালে খোদিত আছে কৃষ্ণ লীলার নানা ভার্স্কয্য। পুকুর পাড়ে রয়েছে এক আর্শ্চয্য অশ্বত্থ গাছ, যার পাতাগুলি অনেকটা ঠোঙার মত মোড়া। মাধবেন্দ্রপুরীর মঠ ও সমাধি দেখলাম রাস্তার পাশে। এখানেও একটা জগন্নাথের মন্দির দেখলাম ।
---------- ৯ ---------
রেমুনা থেকে সোজা এগিয়ে গেলাম বালগোপালপুরের জগন্নাথ মন্দিরের দিকে। রেমুনা থেকে দুরত্ব সাত কিলোমিটার। বালেশ্বরের বালগোপালপুরের এই মন্দিরটির কথা অনেকদিন ধরেই শুনেছিলাম। ইমামি গ্রুপ দ্বারা নির্মিত ও পরিচালিত এই মন্দিরটি পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের অবিকল প্রতিরুপ বলে দাবি করা হয়। তাই ওই মন্দিরটি দেখার ইচ্ছে ছিল বেশ কিছুদিন ধরেই। যদিও মন্দিরটি বেশি দিনের নয়। ২০০৯ সালে মন্দির নির্মাণের কাজ শুরু হয় এবং ২০১৫ সালে নভেম্বর মাসে মন্দিরটির উদ্বোধন হয়।
মন্দিরটা দেখার পর মনে হলো, এককথায় বলতে গেলে অপূর্ব। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের সঙ্গে তুলনা করার মতো ধৃষ্টতা আমার নেই। কিন্তু মন্দিরটি দেখার পর এর স্থাপত্যর প্রশংসা না করে থাকা যায় না। ১১.৭ মিটার উঁচু ওই মন্দিরে ষোলটি কোনারক চক্র আছে। দেখেই বুঝতে পারলাম খুব ভালভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। মন্দিরটির ছাদে ও দেয়ালে শ্রীকৃষ্ণের বাল্য লীলা, বিষ্ণুর দশাবতার এবং পুরাণের অনেক কিছু নিয়ে পট্টচিত্র আঁকা আছে। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের মতোই এখানেও ভোগের ব্যবস্থাপনা রয়েছে। সকালে ও সন্ধ্যায় আরতি হয়। মন্দিরটা দেখার পর ভাবলাম ওই মন্দিরটা না দেখলে, আমার চাঁদিপুর এবং বালেশ্বর ভ্রমণ অসম্পূর্ণ থেকে যেতো। ওখানথেকেই সোজা পান্থনিবাস এলাম। ঠিক আঠাশ কিলোমিটারের ড্রাইভ। সন্ধ্যাবেলায় আবার গিয়ে বসলাম, সমুদ্র সৈকতে। পরেরদিন সকালে বেরিয়ে পড়লাম ফেরারপথে; তারসঙ্গে আবার একটা লম্বা ড্রাইভ।
***** আপনারাও ঘুরে আসুন। খুব ভালো লাগবে। নিজের গাড়ি না থাকলে, গাড়ি ভাড়া নিয়ে যেতে পারেন। অথবা ট্রেনে যেতে পারেন। অনেক ট্রেন আছে হাওড়া থেকে; কয়েকটির নাম দিলাম। ১) ফলকনামা এক্সপ্রেস। ২) ইস্ট কোস্ট এক্সপ্রেস। ৩) করমণ্ডল এক্সপ্রেস।৪) পুরী এক্সপ্রেস। ৫) জনশতাব্দীএক্সপ্রেস। ৬) ধৌলি এক্সপ্রেস। বালেশ্বর থেকে চাঁদিপুরের দূরত্ব ১৬ কিমি। বালাসোর স্টেশন থেকে গাড়ি ভাড়া করে চলে যেতে পারেন চাঁদিপুর থেকে, বালেশ্বরের আশেপাশের জায়গাগুলোতে।

Muktagopal Bhattacharyya

0 comments:

Post a Comment