দুপুরে খেয়ে বেরিয়ে পরি পোখরি হ্রদের দিকে। প্রকৃতি আবার আমাকে অবাক করল যখন জানতে পারলাম ১৪০০ ফিট উচ্চতায় অবস্থিত এই হ্রদের জল ১২ মাস একই থাকে। অবুঝ মনুষ্য জাতি এখানেও ভগবানের দোহাই দিয়ে দুটো ছোটো মন্দির স্থাপন করেছে।
জানতে পারলাম ওই হ্রদে একসাথে ঘর করে মাগুর আর কচ্ছপের দল। কিন্তু এখানেও আমার মন কাড়লো জঙ্গল আর প্রকৃতির নির্ভেজাল সুন্দর্য্য। গাড়ি থেকে নেমে ১.৫ কিমি পাহাড়ের গা বেয়ে আর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ট্রেক করে উঠতে হয়, সে রাস্তায় শুনেছিলাম শুকনো পাতার ওপর পরা পায়ের শব্দ, স্বাদ পেয়েছিলাম এক অসীম স্বাধীনতার, গন্ধ নিয়েছিলাম গন্ধহীন সেই জঙ্গলের , দেখেছিলাম ছোটো বড় অনেক সুন্দর সুন্দর কিট পতঙ্গের দল, অনুভব করেছিলাম নিজের অস্থিত্ব।
নিচে জয়ন্তীর কলকল শব্দ শুনতে শুনতে ওপরে ওঠার সময় গাছের ফাঁক দিয়ে একবার নিচের দিকে চোখ রাখলে দেখা যায় দিগন্ত বিস্তৃত এক জঙ্গল যার রূপে রঙে এত ভিন্নতা তাকে একটি ছোটো অ্যামাজন করে তুলেছে। সবার মত আমিও মুড়ি খাওয়ালাম মাংসাশী সেই মাগুরদের।
বাবার ডাকে ফিরে আসলাম বর্তমান সময়, সেই মায়াবী রাতে। বাধ্য মেয়ের মত ঘরে ঢুকে ঘুম লাগলাম। পরের দিন সকালে উঠে কোকিলের ডাক শুনছি এমন সময় ফোন আসলো মোহন দার, বললো সকালে ভুটিয়া আর চুনিয়া বসতি ঘুরে আসা যেতে পারে। ৩০ মিনিটের মধ্যে বেরিয়েও পরলাম।
ভুটিয়া বসতি আরো নিস্তব্ধ। জঙ্গলের গায়ে মাথা রেখে খুব শান্ত ভাবে ঘুমাচ্ছে গ্রামটা। এই বসতি চারিদিক দিয়ে শুধু সবুজে ঘেরা। এখানেও একটা থাকার ব্যবস্থা আছে। রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকারে রাত কাটানোর মজাটা এখানে পুরো আলাদা। ভুটিয়া বসতি ছেড়ে আমরা চললাম চুনিয়া নদীর ওপর দিয়ে চুনিয়া ওয়াচ টাওয়ারের দিকে। চুনিয়ার শুকনো বুকের ওপর বেড়ে উঠেছে আরেক সুন্দর জঙ্গল। প্রত্যেক বর্ষায় সে জঙ্গল রূপ বদলায়। সাদা পাথরের পথ, আকাশে নিলের ছাউনী আর দুপাশে সবুজের ব্যারিকেড। যত দেখছি তত অবাক হচ্ছি। সেই জঙ্গলে শুধু আমরা, চার পাশে অনেক দুর অবধি নজর রাখলেও দেখা যায় না কোনো মনুষ্য প্রাণ। এই যাত্রাও শেষ হলে ঘণ্টা দেড়েকের মাথায়।
আজ এই স্বর্গীয় আস্থানা ছেড়ে দেবো। তার আগে শেষ বারের মত জঙ্গলকে আলিঙ্গন করব জয়ন্তী বনের সাফারীতে গিয়ে। স্নান খাওয়ার পর বেরিয়ে পরলাম জয়ন্তী নদীকে বিদায় জানিয়ে। ম্লান হয়ে গেল সকল উত্তেজনা। শেষ বারের মত চিকন কালো পাকা রাস্তা ছেড়ে জঙ্গলের কার্পেটে পা রাখলো আমাদের জিপসি। এই বনের কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার বেলা এসে গেছে।
বিদায় জানাতে হবে এই চারিপাশের অপরূপ সবুজকে, চারিপাশে উরে যাওয়া পাখি, প্রজাপতির দলকে, সেই ময়ূর মায়ুরীদের। হরিণের একদল হঠাৎ জঙ্গল থেকে বেরিয়ে ছুটতে লাগলো আমাদের গাড়ির সামনে। প্রকৃতি শেষ বারের মত একটা উপহার দিয়ে জানো বলতে চাইল, "আবার আসিস"। আসবো তো নিশ্চই, এই জঙ্গল কি আর ভোলা যায়? নাড়ির টান তৈরি হয়ে গেছে জানো তার সাথে। বক্সা রিজার্ভের বন এখনও কুমারী, অনাবিষ্কৃত, অপরিচিত কিন্তু আমার মতে এ আমাজনের ছোটো জ্ঞাতি ভাই। দুয়ার্স আগে অনেক বার দেখেছি কিন্তু এরকম প্রকৃতির অস্থিত্ব আর কোথাও টের পাইনি।
বক্সা টাইগার রিজার্ভ ছেড়ে আমরা এবার পারি দিলাম সিকিয়াঝোরার দিকে। ওখানে যাওয়ার একমাত্র উদ্দেশ্য সিকিয়াঝোরার নদীর সাফারি। সিকিয়াঝোরা নদীটিকে দুপাশ দিয়ে ঘিরে রেখেছে বক্সা জঙ্গলের শাখা প্রশাখা। উচ্ছতায় নিম্ন হলেও ঘনত্ব কোনো অংশে কম না। মাঝি ভাইদের কাছে শোনা গেলো এই জঙ্গল থেকে হাতি নেমে মাঝে মাঝেই এই জলে স্নান করে, খেলা করে যায়।
নদী সাফারির শুরুতে একটু কেমন মরা মরা লাগছিল সব কিছু, বক্সার ঘোর কাটিয়ে উঠতে পারিনি ঠিক। কিন্তু মানব সমাজের তৈরি কৃতিম নৌকার ঘাট পেরিয়ে একটু এগোতেই আবার সেই বক্সার কথা মনে পরে গেলো। কুমারী সেই জঙ্গলের নিস্তব্ধতার আওয়াজ শুনতে শুনতে হটাৎ রাঙিয়ে গেলাম চারিদিকের সবুজে। গাছের ছাউনির মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছে ছোট্ট একটু নিল আকাশ। জলের ওপর দিয়ে খুব ধীর গতিতে চলতে লাগলাম। চোখ বন্ধ করলেই অনুভব করা যাচ্ছিল প্রকৃতির শেষ আদর। নানান পাখির কোলাহল শুনতে শুনতে এই যাত্রা টাও শেষ হয়ে গেলো। চারিদিকের সেই নির্ভেজাল গাঢ় সবুজকে শেষ বারের মত মন ভরে দেখে বিদায় নিলাম প্রকৃতির এত যত্ন করে সাজানো এই ভূস্বর্গ থেকে।
এই বেড়ানোটির প্রতিটি অনুভূতি ব্যক্ত করতে গেলে গল্পো উপন্যাসের রূপ নেবে। একটা কথা বলতে পারি দৃঢ়তার সাথে যে আমাদের মত যারা সপ্তাহে দুটি দিন বাঁচার জন্য বাকি পাঁচটি দিন নিজের সাথে আর পৃথিবীর সাথে লড়াই করেন তাদের জন্য এই জয়গা আদর্শ। পরিণত লেখকদের মত না পারলেও চেষ্টা করলাম নিজের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের অভিজ্ঞতা যথা সম্ভব লেখাই তুলে ধরতে। জানাবেন কেমন লাগলো।
Pritha Guha