শিলিগুড়ি থেকে দূরত্ব 54km.(প্রায় ), গাড়িতে যেতে মোটামুটি তিন থেকে সাড়ে-তিন ঘন্টা লাগে।
যাওয়ার পথে গাড়ি থেকে তোলা কার্শিয়াং আমাদের হোমস্টে, মেঘেদের ভিড় জমে উঠছে তখন । কাঞ্চনজঙ্ঘা পিছনে আড়াল পড়েছে ।
হোমস্টে বুকিং করাই ছিল আগে থেকে এবং যাওয়ার গাড়িও হোমস্টে থেকেই arrange করে দিয়েছিল । সকাল সাড়ে ন'টায় শিলিগুড়ি পৌঁছে চটকপুর ঢুকতে ঢুকতে বেলা একটা বেজে গেল (ব্রেকফাস্টের সময় ধরে )।
কালিপোখরী যাওয়ার রাস্তা তে
যাওয়ার পাকদন্ডী পথে একই সাথে পাশাপাশি চলেছে টয় ট্রেনের লাইন, আপাতত ট্রেন বন্ধ, লাইনেও দেখলাম কাজ চলছে টুকটাক, হয়তো আবার চালু হবে শিগগির । নেপালি গানের(গাড়িতে বাজছিল ) সুর ধরে কার্শিয়াং পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম সোনাদা ।
কালিপোখরী, জলের রঙ বারোমাস এই একইরকম । বেশ গা ছমছমে
সোনাদা থেকে ডানদিকে উঠে গেছে খাড়া পথ,আরও ঘন্টা খানেকের রাস্তা । রাস্তার প্রথম কিছুটা অংশ খাড়াই হলেও খারাপ না তবে Senchal ফরেস্টের চেকপোষ্ট থেকে জঙ্গলের রাস্তা শুরু হয়েছে । পাথুরে রাস্তা, গাড়িতে বেশ ভালো রকমের জার্কিং হয় । এইবেলা বলে রাখি চটকপুর এই Senchal ফরেস্টের ভেতরেই, মাঝে মাঝেই জন্তু জানোয়ারও দেখা যায়(হরিণ,লেপর্ড , ব্ল্যাক বিয়ার ) । আমরাও যাওয়ার পথে একটা jungle cat দেখতে পাই ।
জঙ্গলের ভেতরে থাকার জন্য মাথাপিছু 120 টাকা/দিন করে লাগে, গাড়ি রাখলে 400 টাকা /দিন । হোমস্টে পর্যন্ত গাড়িতে যাওয়া যায়নি, গাড়িতে যাওয়ার রাস্তাও নয়, পাথুরে পথ, সিঁড়ি রয়েছে এবড়ো খেবড়ো। মোটামুটি 500/600 মিটার মতো হেঁটে উঠতে হয়। তবে আমাদের হোমস্টে'র লোকেশনটা ওই এলাকার সব থেকে উঁচুতে হওয়ায় একটু বেশি হাঁটতে হয়েছিল । হোমস্টে থেকে হেল্পিং হ্যান্ড পাওয়া যায় এবং ড্রাইভার দাজুও অনেকটা সাহায্য করেছিল ।
আমরা যখন রুমে ঢুকলাম ওয়েদার বেশ মেঘলা ছিল কাঞ্চনজঙ্ঘাও মেঘের পেছনে। মনে একটা সন্দেহ ছিল পরের দিন সকালটা কিরকম হবে সেই নিয়ে । যাই হোক হোমস্টে'তে লাঞ্চ'টা সেরে হাঁটতে বেরিয়েছিলাম একটু । জঙ্গলের ভেতর একটা পোখরি (জলাশয় ) আছে। শুনলাম সেখানে নাকি আবার নেকড়ে'রা রাতের বেলায় জল খেতে আসে । লোকাল গাইড নিয়েই গেলাম । বেশ ইন্টিরিওর লোকেশনে, গা ছমছমে একটা ব্যাপার আছে । জলের রঙ কালো, মাঝে একটা মস্ত পাথর, অদ্ভুত রকম দেখতে । গাইডের মুখে শুনলাম এখানে নাকি জঙ্গলের পুজো হয়, পবিত্র স্থান। কিছুক্ষণ থেকেই ফিরে আসি রাত হওয়ার আগেই । যাওয়ার রাস্তাটাও চমৎকার । দুপাশে পাইন, মাঝে পথ ।
সন্ধে হতেই মেঘ কাটতে শুরু করে, পূর্ণিমার কিছুটা আগের সময় হওয়ায় কাঞ্চনজঙ্ঘাও হাল্কা দেখা যাচ্ছিল ওই চাঁদের আলোয় । রাতের আকাশে এত তারা'ও এভাবে আমাদের শহরে দেখা যায় না । তবে রাত বাড়ার সাথে সাথে ঠান্ডাটাও বাড়তে থাকে। বলে রাখা ভালো ডিসেম্বরের শেষ থেকে জানুয়ারীর মাঝামাঝি বেশ ভালো ঠান্ডা থাকে এখানে । রাতে তো টেম্পারেচার মাইনাস এও নেমে গিয়েছিল । দুটো কম্বল নিয়েও শান্তি হচ্ছিলো না, অবশ্য সেরকম অসুবিধা হলে রুম হিটার এর ব্যবস্থা আছে, 300 টাকা /রাত ।
সকালে ঘুম ভাঙলো তখন ঘড়িতে পাঁচটা । অ্যালার্ম দেওয়াই ছিল । রুমের দরজা খুলে বারান্দা'তে এসে দেখলাম চারিদিক বেশ অন্ধকার তখনও, ঠান্ডাও তুমুল । মোটামুটি একটু ফ্রেশ হয়ে চাদর টুপি সোয়েটার মাফলার জড়িয়ে বাইরে এলাম, তখন অন্ধকার কাটছে ধীরে ধীরে । কাঞ্চনজঙ্ঘাও আবছা দেখা যাচ্ছে দূরে, তবে বেশ বুঝলাম আর বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে না, কিছুক্ষণের মধ্যেই স্বমহিমায় তিনি প্রকাশ পাবেন । লনে পা দিয়েই দেখি ভোরের শিশির জমে বরফ, মাটিতে যেদিকেই চোখ যায় সাদা বরফ জমে রয়েছে ।
পুলকের আর সীমা রইলো না। ঠান্ডায় জমতে জমতে আর উত্তেজনার পারদে লাগাম দিয়ে ভিউপয়েন্টে পৌঁছে দেখলাম আরও কয়েকজন আপাদমস্তক ঢেকে ক্যামেরা আর ফোন নিয়ে রেডি হচ্ছে ।
এই জায়গাটা থেকে পুরো 360° ভিউ পাওয়া যায় । একপাশে কাঞ্চনজঙ্ঘা আরেকপাশে সূর্যোদয়ের অপেক্ষা । বেশ সুন্দর একটা লাল ফ্লুরোসেন্ট স্ট্রিং লাইট এর রেখা সমস্ত পূর্ব দিকটা জুড়ে । আরেকপাশে কাঞ্চনজঙ্ঘা ধীরে ধীরে রঙ বদলাচ্ছে । কখনও হাল্কা সাদা, তারপর একটু হলুদ, তারপর হাল্কা লাল । বেশ ওপাশে দেখি একটা আস্ত লাল বল ধীরে ধীরে উঁকি মারছে, অর্ধেক অংশ বেশ টকটকে লাল, নীচের অংশ তখনও কালচে । ধীরে ধীরে পুরো গোলটাই বেরিয়ে এল লাল রঙ নিয়ে, ধীরে ধীরে বেশ একটা গোল্ডেন রেডে। সত্যিই মুহূর্তটা স্বর্গীয়(একটুও বাড়িয়ে বলছি না)। ফোটোগ্রাফি সেরে এক বুক আনন্দ নিয়ে রুমে ফিরলাম যখন দেখি হাত বাড়ালেই কাঞ্চনজঙ্ঘা । রুমের জানালা দিয়েও তার অনবদ্য উঁকিঝুকি । নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে বাধ্য হবেন । এখানে থেকে স্লিপিং বুদ্ধার পুরো রেঞ্জটাই দেখতে পাওয়া যায়, তাছাড়াও আরও অনেক পিক এখানে থেকে দেখতে পাবেন ।কপাল ভালো হলে বরফপাত'ও পেতে পারেন ।
চেষ্টা করবেন ভিউ রুম নেওয়ার, রুম থেকেই কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে পারেন। ননভিউ রুমেও চাপ নেই, একটু বেরিয়ে এসে দেখতে হয় ।
খাবার-দাবার ঠিকঠাক (লাঞ্চে ডিম হলে ডিনারে চিকেন বা উল্টোটা, ভেজও রয়েছে । সকালে লুচি তরকারি, এছাড়াও চা রয়েছে )।
এই covid সিচুয়েশনে sanitizer, mask(extra), disinfectant spray সবসময় ক্যারী করবেন । যতটা সম্ভব মানবেন, তবে অহেতুক খুঁত খুঁত করে ঘোরার আনন্দ মাটি না করাই ভালো ।