Sunday, January 23, 2022

তুলিন : সুবর্ণরেখার তীরে পুরুলিয়ার শেষ গ্রাম - Tulin, the last village of Purulia on the bank of Subarnarekha

 তুলিন : সুবর্ণরেখার তীরে পুরুলিয়ার শেষ গ্রাম .......

**************
তুলিনের সুবর্ণ.....
নাকি সুবর্নের তুলিন ?
ঝাড়খণ্ডের সীমান্ত....
নাকি পশ্চিমবঙ্গের ?
একা যাবো...
নাকি দুজনে ?
একটা দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে শুরু করলাম আজকের বেড়ানোর কথা ....
পুরুলিয়া নামটা শুনলেই আগুনরঙা পলাশের ছবি ভেসে ওঠে চোখের সামনে ।
.....ভেসে ওঠে ন্যাড়া পাহাড়, সবুজ পাহাড় ,টিলা , ডুংরী ও জলভরা ড্যামের ছবি .....!!



কিচ্ছু করতে হবে না ...... শুধু একটা ভিউ পয়েন্ট থেকে মাখনমাখা... কালো ফিতের মতো.... পাহাড় কে জড়িয়ে সোহাগ করা ..... পাকদন্ডী রাস্তার ছবি তুলুন ..... ব্যস! কেল্লাফতে!!!!

                                    Tulin Heritage Bunglow..... Tulin, Purulia, West Bengal

পাখিপাহাড় ..... অযোধ্যা পাহাড় .... বাগমুণ্ডি ....... গড় পঞ্চকোট..... বড়ন্তি কোনটা ছেড়ে কোনটা বলি !
ছৌ নাচ , চড়িদা গ্রামের মুখোশ সহ হাজারো শিল্প সংস্কৃতির মিশেল দিয়ে পুরুলিয়া যেন পটে আঁকা এক ছবি !!!
শীতের পরে পরেই পুরুলিয়া যেন বিয়ের কনের সাজে সেজে ওঠে ..... লাল চেলি যেমন কনের রূপ ফুটিয়ে তোলে,পুরুলিয়ার পলাশও তাই !!
আমরা মুগ্ধ হই পুরুলিয়ার রূপে ,ছুটে যাই ......
গেয়ে উঠি ....." চল পলায়ে যাই ......."
সবাই মেতে উঠি পরিচিত পুরুলিয়া কে নিয়ে .....
আর ঠিক তখনই ঠোঁট ফুলিয়ে অভিমান করে "তুলিন" সুন্দরী ... সুবর্ণের কাছে অভিমান করে বলতে থাকে ......
" আচ্ছা ,তুমি বলতো .... আমি কিসে কম যাই ..... কি নেই আমার !"

                        ১৩০ বছরের মা শ্মশান কালীর মন্দিরের পাশে স্থাপিত ছয়টি মন্দির

সুবর্ণ আসলে সুবর্ণরেখা ..... সোনা উগ্লানো নদী আর তুলিন ,পুরুলিয়ার শেষ গ্রাম ......পশ্চিমবঙ্গ - ঝাড়খন্ড সীমান্তে ।
অসংখ্য ছোট ছোট পাথুরে পাহাড় যেন তুলিন সুন্দরীকে ঘিরে রেখেছে.... আর সুবর্ণরেখা বা স্থানীয়দের ভাষায় স্বর্নরেখা নদী যেন তাকে ভালোবেসেই শ্লথগতি হয়েছে .......
উদ্ভিন্ন যৌবনা তুলিন কে দেখে ধীরগতি সুবর্ণ যেন বলে ওঠে ....." ও কেন এত সুন্দরী হলো ....... "
তুলনামূলক ভাবে "তুলিন " অনেকটা কম পরিচিত নাম ......
কিন্তু তার কাছে যাওয়া যায় সহজেই
কিন্তু ......



কিভাবে যাবেন...
****************
হাওড়া থেকে হাওড়া- রাঁচি শতাব্দী এক্সপ্রেস , ক্রিয়াযোগ এক্সপ্রেস অথবা হাওড়া - রাঁচি ইন্টারসিটি এক্সপ্রেস ধরে খুব কম সময়েই পৌঁছে যাওয়া যায় " মুরী" স্টেশনে ..... যেখান থেকে তুলিন যাওয়া তো শুধু অটোতে চাপা আর নামা!!!
আমার মত যাদের... সাঁতরাগাছি-পুরুলিয়া ধরে পুরুলিয়া যেতে পারলে সুবিধা হয় ..... তাদের চিন্তা নেই ...... দুপুরে পুরুলিয়া পৌঁছে লাঞ্চ করে বিকেল তিনটেতে পাবেন তুলিন যাবার ট্রেন ..... বিকেল সাড়ে চারটার আগেই পৌঁছে যাবেন তুলীন।
আর যদি আপনি মনে করেন আমার মতো বাইকে যাবেন তাহলে সোজা চলে আসুন বাঁকুড়ার ধলডাঙায় ....ধরুন পুরুলিয়ার রাস্তা, পৌঁছে যান ঝালদা ...... তারপর সেখান থেকে ১০/১২ কিমি দূরে তুলিন ......
যে বন্ধুরা কলকাতা থেকে আসবেন তাদেরও সামনে দুটো পথ ভায়া বর্ধমান পানাগড় ফ্লাইওভার দিয়ে আসানসোল ..... রঘুনাথপুর হয়ে তুলিন ।

                                সুবর্ণ রেখার বুকে ব্রিটিশ আমলে তৈরি এই সেতুস্তম্ভগুলি

.... নতুবা চলে আসুন বাঁকুড়ায় আমার সঙ্গী হতে ....
কলকাতা থেকে তুলিনের দূরত্ব ( by road) 319 কিমি । সময় লাগার কথা 7 ঘণ্টা বড়জোর......
থাকবেন কোথায় :
****************
থাকার একটাই জায়গা .....
"তুলিন হেরিটেজ বাংলো".......
হ্যাঁ,হেরিটেজ ই তো !
১৯৩০ সালে তৈরি ,২০২০ তে নব কলেবর পেয়ে হেরিটেজ এই বাংলোও যেন এক দর্শনীয় স্থান হয়ে উঠেছে ... নিজের কৌলিন্যে !
মূল রাস্তা ছেড়ে এই বাংলোতে পৌঁছেই হবে ...." Love at first sight "



...... বাংলোর সামনের হরেক রকম গোলাপের বাগান আর সুদীর্ঘ গাছেরা দাঁড়িয়ে আছে ....আপনাকে স্বাগত জানাতে !!!
ওরা শুধু আপনাকেই স্বাগত জানাচ্ছে না ...... আগেই ওরা এই হেরিটেজ বাংলোতে স্বাগত জানিয়েছে ....
বিমল মিত্র
বিভূতি ভূষণ বন্দোপাধ্যায়
মহিষাদলের রাজকুমার
ঝালদার রাজা কে.....
তাঁদের মধ্যে যারা পাশের জঙ্গলে শিকারে গেছেন ..... শিকার করেছেন .... প্রমাণ গুলো আজও সাজানো আছে ...বর্তমান এই দোতলা বুটিক বাংলোর দেওয়ালে.....
কলকাতার মহিম চন্দ্র দে সরকার ছিলেন প্রখ্যাত ব্যবসায়ী .....তিনিই এই হেরিটেজ বাংলোর স্থাপক। খিদিরপুরের এই পরিবারের পরবর্তী বর্তমান প্রজন্ম ,এই ২০২০ সালে ২.৫ একর জমিতে এর নবারুপায়ন ঘটিয়ে এটিকে " তুলিন হেরিটেজ বুটিক বাংলো " তে পরিণত করেছেন ....
বাংলোটি দোতলা এবং লাল রঙের মেঝে ও কাঠের জানালা দরজার অ্যান্টিক রূপে অনেকটা একান্নবর্তী পরিবারের বড়ো বাড়ির মতো ।
টানা বারান্দার প্রান্তে ধোঁয়াওঠা কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে প্রকৃতি দেখার
অঢেল ব্যবস্থা .....
নীচের তলায় খাবার জায়গাটিও খোলামেলা ...... বেশ ভালোলাগার মতো .....

                                                            Tulin Heritage Bunglow


                                                     

গোলাপ বাগান,লম্বা লম্বা গাছের সারি ,কাছের শাল জঙ্গলে বার্বিকিউ, বনফায়ার আর কাছেদুরের আদবাসী গ্রামের ধামসা মাদলের বোল আপনার মন ভালো করবেই ,এটা বাজি রেখেই বলা যায় !
বাংলো থেকে ২০ কিমি দূরেই বানসা, কামারা ও বুরুডি রয়েছে আপনারই প্রতীক্ষায় !
আর যুড়াবন জঙ্গল রয়েছে আপনার হাতের নাগালেই যেখান দিয়ে আপনি যেতেই পারেন উপজাতি গ্রামগুলোর রূপ দর্শনে "মাহাতোমারা" কে ভায়া করে ....
তিন রকম রুম রয়েছে এখানে আকারের তারতম্যে। কিন্তু পরিষেবা এক সবার জন্য .... ৩০০০- ৪০০০ এর মধ্যে .....
একমাত্র থাকার জায়গা ,তাই বুক করেই যাবেন ..... পাকা কথা বলবেন সারন্য দে ভাইয়ের সঙ্গে ....
মোবাইল :9088810611
নেট সার্চেও মিলবে ওই বাংলোর হাল হকিকত .....
এখন প্যান্ডেমিক পরিস্থিতির জন্য ওরা কিছুটা ছাড়ও দিচ্ছে ....

কি খাবেন ....
*********
সকালের ব্রেকফাস্ট তো কমপ্লিমেন্টারি .....
দুপুরে মাছ,ভাত,পোস্ত,সব্জি ছাড়াও আপনি চাইনিজ ,কন্টিনেন্টাল সব ধরনের খাবার ও ব্রেকফাস্ট পাবেন ..... ইনস্ট্যান্ট চা কফির জন্য রুমে ইলেকট্রিক কেটেল এর ব্যবস্থা আছে।
ড্রাইভারের থাকাখাওয়ার ব্যবস্থাও আছে সামান্য এক্সট্রার বিনিময়ে ....
একটি তিনজনের পরিবারের সব খাবার মোটামুটি এক থেকে দেড় হাজারে মিলবে, দিন পিছু।


কি দেখবেন :
***********
অন্ততঃ দুটো রাত থাকুন।
আমার মতে তুলিন এলে তুলিনের কাছে পিঠের গ্রাম্য পরিবেশ,প্রকৃতি দেখেই কাটালে খুব ভালো লাগবে ....
তবে এখান থেকে অনেক জায়গা আপনি যেতেই পারেন .....
যেমন.....
Muruguma Dam- --- 25 km
Hudru Falls ------------ 30 km
Bagmundi village----35 km
Jonah Falls -------------42 km
Ajodhya Hills-----------46 km
Khairabera Dam -----52 km
তবে যেখানে যান , তুলিনকে বাদ দিয়ে,উপেক্ষা করে নয় !
পায়ে হেঁটে ,গাড়িতে ....যেমন ভাবে হোক বাংলো থেকে বেরিয়ে বাম দিকে 1.5 কিমি স্ট্রেট চলুন, তারপর ডানদিকে এগিয়ে হনুমান মন্দিরের কাছে "Y" ফর্ক থেকে নামোপাড়া দিয়ে সংকীর্ণ রাস্তা বেয়ে নেমে আসুন সুবর্ণরেখার পাথুরে বুকে......
আর সারাজীবন মনে রাখার মতো স্মৃতি নিয়ে যান ..... সুবর্ণের বুকে সূর্যাস্ত দেখে ।
ভুলবেন না যেন ,এ দৃশ্য ক্যামেরা বন্দী করতে , অনুরোধ রইলো।
অন্ততঃ একবার দর্শন করুন 130 বছরের মা শ্মশান কালীর মন্দির ,এই নদীর বুকেই.... যেখানে আপনি এখন আছেন ...
কার্তিক সংক্রান্তিতে এখানে কীর্তন, ভজনের আসর বসে ....পুণ্যার্থীরা স্নান সেরে পুজো দেন .......
আর তাই আরও ছয়টি মন্দির স্থাপিত হয়েছে ..... মহাদেব,মহালক্ষ্মী,ধর্মরাজ, সূর্য ,শীতলা ও গায়ত্রীদেবীর......
একবার তাকিয়ে দেখুন পুরানো ব্রিটিশ আমলের ব্রীজের পিলার গুলো কেমন আজও স্বগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে সুবর্ণ রেখার বুকে .....
নতুন ব্রীজ থেকে সুবর্ণের অপরূপ রূপ ক্যামেরা বন্দী করুন ..... আর ফেরার সময় দেখুন ..... ঝাড়খণ্ডের সাগুম দ্বারম অর্থাৎ স্বাগত তোরণ ...
এখনই যেতে পারেন আপনার অশান্ত,অস্থির মনে শান্তির ,স্বস্তির প্রলেপ দিতে ..... আপনার প্রিয় সঙ্গীর সাথে দুটো প্রাণের কথা নিরিবিলিতে বলতে ....পুরুলিয়ার এক ভিন্ন রূপ দেখতে .....
অথবা
রক ক্লাইম্বিং, ক্যাম্পিং ,সাইক্লিং করতে....
অথবা
শুধুই আপনার দেশের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা দেখতে ..... ছোট ছোট পাহাড়ে ,জঙ্গলে নিজেকে হারিয়ে দিতে !!
যাই করুন .....
বার্বিকিউ, শালচিকেন আর বন 🔥 ফায়ার এর সাথে একটু নাচ গানে অংশ নিতে লজ্জা করবেন না যেন !!
আসুন ,একটু মকসো করে নিই .....come on,please....!!
"কালো জলে কুচলা তলে ডুবল সনাতন...
আজ সারা না, কাল সারা না পাই যে দরসন৷
লদীধারে চাষে বঁধু মিছাই কর আস
ঝিরিহিরি বাঁকা লদি বইছে বারমাস৷
চিংরিমাছের ভিতর করা, তায় ঢালেছি ঘি
নিজের হাতে ভাগ ছাড়েছি, ভাবলে হবে কি?
চালর চুলা লম্বা কোঁচা খুলি খুলি যায়
দেখি সামের বিবেচনা কার ঘরে সামায়৷
মেদনিপুরের আয়না-চিরন, বাঁকুড়ার ঐ ফিতা
(আর) যতন করে বাঁধলি মাথা তাও যে বাঁকা সিঁথা৷
পেছপারিয়া রাজকুমারি গলায় চন্দ্রহার
দিনেদিনে বাইড়ছে তুমার চুলেরই বাহার৷
কলি কলি ফুল ফুটেছে নীলকালো আর সাদা
কোঁড় ফুলেতে কিষ্ট আছেন কোঁড় ফুলেতে রাধা......"
Disclaimer: Some pictures are taken from internet for representation purpose only

Ranjit Dutta

0 comments:

Post a Comment