বক্সা টাইগার রিজার্ভ - পর্ব ১ :
বৃষ্টির কান-ফাটা শব্দে ঘুমটা ভেঙে গেলো রাতের কোনো এক গভীর সময়। পাশেই জানলা, পর্দাটা একটু সরিয়ে কাঁচের ওপারে দেখার চেষ্টা বৃথা হলো, দূর্ভেদ্য অন্ধকারে চারিদিকটা ঢাকা পরেছে। আমার বুদ্ধিমান ফোনটাকে একটু ধরে ঝাঁকাতেই তার পেছনের টর্চ জলে উঠলো। বিছানা থেকে কাঠের মেঝেতে পা রাখতেই মেঝেটা বিরক্তের সাথে ক্যাচ্ করে উঠলো। হাওয়ার আওয়াজে দরজাটা আলতো দুলছে, কাছে গিয়ে কান পাতলে শোনা যায় হাওয়ার সাঁই সাঁই শব্দ, সেই শব্দ পরিবেশটাকে আরো বেশ খানিকটা ছমছমে করে তুলেছে।
দরজাটা খুলে বাইরের বারান্দায় এসে দাড়ালাম। ঠাণ্ডা হাওয়ার সাথে বৃষ্টির ছাঁট গায়ে ছুঁয়ে সারা শরীরে কাঁটা দিয়ে যাচ্ছে। মুশুলধারে বৃষ্টি পড়ছে টিনের চালের ওপর, একটা ভেজা চেয়ারের ওপর গিয়ে বসলাম। আমার বুদ্ধিমান ফোন বলছে ১:৪২ বাজে। ফোনের আলোটা বেশ বিরক্তকর, টেবিলের ওপর দিলাম ওটার মুখ উল্টে। সামনের নির্ভেজাল অন্ধকারের দিকে চোখ রাখতেই কেমন একটা রোমান্টিসিজম জড়িয়ে ধরলো চারিদিক দিয়ে। এই বক্সা টাইগার রিজার্ভের মাঝে আর জয়ন্তী নদীর কাখে অবস্থিত জয়ন্তী রিভার ভিউ হোমস্টেতে এসেছি গতকাল, থাকবো আগামীকাল অবধি। ফ্ল্যাশব্যাকের মত চোখের সামনে ভাসতে লাগলো পূর্ব পর্বের কথা।
অনেকদিন ধরে বোকা বাক্সকে (অর্থাৎ কম্পিউটারকে) খোঁচা মেরে মেরে আর তার ইঁদুরের ঘাড় নারিয়ে ইন্টারনেট বাবাজির থলি তন্যতন্য করে খুঁজে বার করেছিলাম এই জায়গাটার আপাদমস্তক সব তথ্য। কাঞ্চনকন্যায় সিট সংরক্ষণ করেছিলাম প্রকৃতিকে আরও কিছুটা বেশি উপভোগ করতে। নিউ জলপাইগুড়ি ছাড়ার পর কখনও চেনা অচেনা নদীর ওপর দিয়ে, তো কখনও দূর্ভেদ্য জঙ্গলের বুক চিরে কাঞ্চন নন্দিনী আমাদের আলিপুরদুয়ার পৌঁছে দিয়েছিল নির্ধারিত সময়ের ঠিক ২ ঘণ্টা পর। প্রথম দেখাতেই প্রেমে পড়ে গেছিলাম এই শত শত রকমের গাছের গভীর সারির। ৭৬০ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে ঘর বেঁধে রয়েছে এই ইকোলজিকাল হটস্পট, প্রকৃতি প্রেমীদের কাছে এক অর্থে স্বর্গ। একদিকে যদি হয় নাম না জানা গাছের অভেদ্য বসতি, তাহলে অন্য দিকে শাল বনের সরলতা। এতে মন না ভরলে রয়েছে গর্জনের ঘন ছাউনী, সাভানা গ্রাসল্যান্ডের মানুষ সমান ঘাসের সারি আর শতক হাজার বছরের সাক্ষী হিসাবে রয়েছে কিছু মরা, কিছু আধ মরা আর কিছু জীবন্ত গাছের প্রাণ। সব মিলিয়ে প্রায় ৪৫০ প্রজাতির জানা অজানা গাছের চিরন্তন ঠিকানা লুকিয়ে আছে এই ১০ রকমের জঙ্গলের মধ্যে।
স্টেশন থেকে ১৫ কিমি দূরে রাজাভাতখাওয়া জঙ্গলের প্রবেশ দ্বার, সেখান থেকে যৎসামান্য টাকা আর পরিচয় পত্রের বিনিময় পরের তিনদিন জঙ্গলে থাকার আর ঘোরার অনুমতি পত্র আদায় করে আমরা প্রবেশ করলাম সবুজ নির্ভেজাল, নির্লোভ, নিঃস্বার্থপর এই প্রকৃতির ছাউনীতে। জঙ্গলের মাঝ দিয়ে চলে গেছে ঝা চকচকে পাকা রাস্তা, গাড়ির জানলার ওপর হাল্কা করে মাথাটা এলিয়ে দিলে খুব মিষ্টি হাওয়া এসে আদর করে যায়, মনে করিয়ে দেয় ভুলে যাওয়া ফাল্গুনের সেই প্রসন্ন আবহাওয়া। সূর্যের আলো দুধারের গাছের সারির ওপর গয়না পরিয়েছে। আরও ১৫ কিমি গাড়িটা ছুটে চললো খুব যত্নে আঁকা এই ক্যানভাসের ওপর দিয়ে, তারপর পৌঁছালাম জয়ন্তী নামক এই ছোট্ট বসতিটিতে, মোট সময় লাগে প্রায় ১ ঘণ্টা। ঠিক এই গ্রামটির গা এলিয়ে চলে গেছে জয়ন্তী নদী। বর্ষাকালের তিনটি মাস এই নদী ভয়াবহ রূপ নিলেও, বছরের বাকি সময়টা থাকে শুধু শুকনো নদী গর্ভের সাদা পাথরের ওপর দিয়ে করা স্বচ্ছ জলের আঁকিঝুকি। মাত্র ২০০০ প্রাণ নিজেদের ঘর, স্কুল, দোকান, স্বাস্থ্য কেন্দ্র নিয়ে নিজেদের মতো করে একটা পুরো ভিন্ন পৃথিবীর স্থাপন করেছে। আর এই পৃথিবীতে নিজদের বাড়ি গুলিকে হোমস্টেতে রূপান্তরিত করে প্রকৃতি প্রেমীদের সুযোগ করে দিয়েছে এই স্বপ্নের মতো অস্থানায় এসে নিশ্বাস ফেলার।
সেদিন বিকালে এসেই বেরিয়ে পড়েছিলাম ছোট মহাকাল মন্দিরের উপলক্ষ্যে, স্ট্যালাকটাইট আর স্টালগেমাইট এর তৈরি এই গুহারর পরিচয়ের বদল ঘটেছে ধর্ম ভীরু মনুষ্য জাতির দয়ায়। আমাদের জিপসি গাড়ি জয়ন্তী নদীর এব্রক্ষেব্র বুকের ওপর দিয়ে কোনো তোয়াক্কা না করে ঊর্ধ্বশ্বাসে লাফাতে লাফাতে চলছিল, মাঝে মাঝে তাকে শান্ত করে তুলছিল হাল্কা স্রোতে বোয়ে যাওয়া এই জয়ন্তীর কিছু নাড়ি। চওড়া নদী বক্ষের দু ধারের ঘন জঙ্গলে ঢাকা পাহাড় ধীরে ধীরে কাছে আস্তে লাগলো। বা দিকের জঙ্গল এবার রূপ ধারণ করলো সাভানা গ্রাসল্যান্ডের, কিন্তু ডান দিকটা তখনও গো ধরে বসে রয়েছে তার পূর্ব সাজ নিয়ে। আরও কিছু দূর গিয়ে মহাকালের পাহাড়ের পদ ভূমিতে এসে শান্ত হলো গাড়ির ইঞ্জিন।
নদীর পাশ দিয়ে, পাহাড়ের গা বেয়ে কিছুটা উঠে দেখা মিলল স্টালাক্টাইট আর স্টালেগমাইটের গঠন গুলোর, ছোটো হলেও প্রথম দেখাতে ভালোই মন কারলো। পাশে ছিল একটা ছোটো ঝর্ণা। বড়ো মহাকাল আরো অনেক উঁচুতে, রীতিমতো ট্রেক করে উঠতে হয় কিন্তু উপহার স্বরূপ পাবেন আরো সুন্দর প্রকৃতি, আরো বিস্ময়কর গুহা আর আরো রোমাঞ্চকর এক অনুভূতি। একটা কথা তো বলাই হলো না, রাজাভাতখাওয়া জঙ্গলে পা ফেলার পর থেকে আমাদের গাইড হিসাবে রয়েছে অসংখ্য রঙবেরঙের পাখি, প্রজাপতি আর ময়ূর, কিছুটা ভালো করে লক্ষ্য করলে নজরে পরবে নানান রঙ রূপে সজ্জিত কিট পতঙ্গের দল। জিপসি আমাদের হোমস্টেতে নামিয়ে দিল সন্ধ্যা হাওয়ার কিছু আগেই। পূর্ণিমার রাতে জয়ন্তী সজ্জিত কনের মত সুন্দর লাগে। সাদা পাথর চাঁদের আলোর আভায় আরও স্নিগ্ধ হয়ে উঠেছে। রাতের নিস্ত্ধতায় কান পাতলে শোনা যায় স্বল্প জলের কোলাহল, নিশির আলো তার গায়েও মাখিয়ে দিয়েছে অজস্র অভ্র। চাঁদও জানো পৃথিবীর এ রূপ দেখে নেচে উঠেছে। কিন্তু সে রাতেও বৃষ্টি হয়েছিল। রাতের শেষ অধ্যায় অবধি দেখা যায়নি চাঁদের থালার মত গোল মুখখানি।
বিদ্যুতের গর্জনে ঘোর কাটল। বৃষ্টি আরও জোরে ধেয়ে আসছে পৃথিবীর দিকে। গায়ে একটা হাল্কা চাদর জড়ানো ছিল, সেটাতেও মানছে না ঠান্ডা, ঠিক সকালের মত। আজ সকালে ঘুম ভেঙেছিল দিনের প্রথম আলোর সাথে। বাইরে পা দিতেই গায়ে লাগলো বেশ ঠান্ডা হিমের হাওয়া। পাহাড় তখনও কুয়াশার চাদর গায়ে, বৃষ্টিতে স্নান করে গাছের রঙ আরও ফুটে উঠেছে। পাখিদের কিচিরমিচির শব্দে আড়মোড়া ভাঙছে ঘুমন্ত গ্রামটা। প্রকৃতির আলসেমি দেখতে দেখতে হোমস্টে ছেড়ে এগিয়ে গেলাম নদীর গর্ভে ওই নতুন হওয়া জলের প্রবাহর দিকে। ঘোলাটে জল হলেও পাথর গুলো ভালোই পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। হঠাৎ উল্কির মত বৃষ্টি পরতে লাগলো। ফিরে এসে কম্বলের তোলাই আর এক পর্ব ঘুমের উপক্রম করতে লাগি। ৮ টার দিকে যখন আবার ঘুম ভাঙলো তখন বৃষ্টি থেমে গেছে। আজ যাবো পাকা রাস্তা ছেড়ে জঙ্গলের ভেতরের কাঁচা রাস্তা দিয়ে জঙ্গলটাকে আরও কাছ থেকে দেখতে। রাজাভাতখাওয়ার প্রবেশ দ্বার থেকে সাফারির বিশিষ্ঠ জিপসি করে ঢুকলাম জঙ্গলের গভীরে।
সে এক অপরূপ শোভা। গাড়ি চলেছে এক পাশে সাজানো গোছানো শালের বন আর অন্য পাশে বহু পুরনো গাছের অগোছালো বসতির মধ্যে দিয়ে। এই বনের সাজ বদলাচ্ছে মুহূর্তের মধ্যে। একটি নাম না জানা গাছ সটান উঠে গিয়ে ছুয়েছে আকাশের নীল শরীরে, গাড়িটা থামলো হঠাৎ তার ঠিক পাশে। আমাদের গাইড মোহন দার দিকে তাকাতেই নজরে পরলো এক অদ্ভূত উৎকণ্ঠা, জিজ্ঞাস করায় জানতে পারলাম যে তারা হাতির গন্ধ পাচ্ছে, নিশ্চই খুব কাছে। জঙ্গলে পশু দেখার আশায় কোনোদিনই আসি নি, কিন্তু চারিদিক দিয়ে যখন গভীর সবুজে ঘেরা, হার হিম করা নিস্তব্ধতার মাঝে আমাদের অশান্ত জিপসি শান্ত ভাবে ভয়ে কুকরে দাড়িয়ে আছে তখন কি জানো একটা আমাকেও ভর করলো। শুকনো পাতা পরার আওয়াজেও কেপে উঠছে মন টা। খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে গাড়ির ইঞ্জিন মৃদু স্বরে আওয়াজ করে চলতে লাগলো।
বনেরও এক আলাদা অদ্ভুত গন্ধ আছে, বিজ্ঞান ঘ্রাণ বন্দী করার কোনো এক যন্ত্র আবিষ্কার করলে বনের সেই গন্ধকে ধরে আনতাম আমার সাথে কলকাতায়। স্বপনের মত লাগছিল এই জঙ্গলে ঘোরার অভিজ্ঞতা, পাখি উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে, প্রজাপতি খেলে বেড়াচ্ছে ঝাঁকে ঝাঁকে, ময়ূর কোথাও পেখম তুলে মায়ুরীকে ইশারা করছে তো আবার কোথাও আমাদের মাথার ওপর দিয়ে এক ডাল থেকে অন্য ডালে উড়ে যাচ্ছে। মাথার ওপর এক ফালি নিল আকাশ ছাড়া বাকি চারিপাশ রাঙিয়ে রয়েছে সবুজের বিভিন্ন রঙে। মাঝে মাঝে জঙ্গল ছেড়ে শুকনো বালা নদীর ওপর দিয়ে যাচ্ছে আমাদের সাওয়ারী। ঘরে ফিরে আসলাম ঘণ্টা দুয়েক পরে।
Pritha Guha



















