অপার সৌন্দর্যের চাবিকাঠি খুঁজতে যখন বিষ্ণুপুর যাওয়া তখন শুধুই চেয়ে থাকি,,,,, আঁখি ফিরাইতে না পারি,,,,,,,,........।
শিল্পীর তুলিতে যেমন মনের ক্যানভাস আঁকা হয়ে যায় তেমন করেই বোধহয় আমার দুনয়নে ভরে আছে শিল্প স্থাপত্যের এমন অনবদ্য নিদর্শন যাকে শুধু ছবিতে দেখলে মন ভরে না,,,,,অনুভূতির পরশ নিতে গেলে অবশ্যই অনুভব করতে যেতে হবে মল্ল রাজাদের বিষ্ণুপুর।
বিষ্ণুপুরে প্রবেশের প্রধান ফটক
শুরু হল পথ চলা সকাল বেলা নিজেদের ঠিক করা বাহন কে নিয়ে সঙ্গে আমার আপনজন তাই চিন্তা কম আর প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হওয়া বেশি,,,,একটুও সুযোগ ছাড়িনি।পথে রাস্তা বেশ ভালোই ছিল তবে আরামবাগ হয়ে যাবার পরই রাস্তায় কাজ হবার জন্য অনেকক্ষণ সময় পার হয়ে যায় পৌঁছতে। হোটেলে পৌঁছতে প্রায় সন্ধ্যা নেমে আসতে পারে বুঝতে পেরে আমরা হোটেলে পৌঁছানোর আগেই বনলতা তে দুপুরের ভোজন টা সেরে নিই।
রাস মঞ্চ
বনলতা কে প্রাকৃতিক ভাবে যতটা সাজানো যায়(সবজি থেকে ফুলের চাষ, এমু পাখি থেকে শুরু করে র্টাকি,কড়কনাথ মুরগি, খাঁটি গরুর প্রতিপালন, পুকুরে মাছের চাষ) বা অথিতি আপ্যায়ন ও বেশ মন ভরিয়ে দেয় তবে বাদ সাধে আমাদের বাঙালি লোভী খাদ্যরসিক মন,,,,,কিছুই ছাড়তে চায় না,,,তাই যথারীতি প্রায় সবরকম রান্নাই স্বাদ আস্বাদন করার ইচ্ছে জাগে (যতটা খাওয়া যায়) কিন্ত একটু নিরাশ হতে হয় কড়কনাথ মুরগির পিস দেখে এবং সঙ্গে টার্কি মুরগির পিসের ও একই অবস্থা।
রান্নাঘর যা আজ ধ্বংসাবশেষ
তবে ওখানকার মানুষের ব্যবহারে মনটা ভরে গেছে বলে ততটা খারাপ লাগে না,,,,পরের দিন আবার যখন দুপুরের আহার করতে গিয়েছিলাম তখন আর মুরগী না খেয়ে মাছ খাই যা খুবই সুস্বাদু ছিল।
সাল লিপিবদ্ধ করে রাখা হয়েছে শ্যাম রাই মন্দির রাধামাধব মন্দির
যাইহোক বেশ খাওয়া দাওয়া সেরে যখন বিষ্ণুপুর পৌঁছলাম তখন সন্ধ্যায় চারিদিক সেজে উঠেছে আলোয় আলোয়,,,কারণ ওখানে তখন বিষ্ণুপুর মেলা চলছে। যার অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখের হয় নি প্রথমেই।
"তোমায় হৃদ মাঝারে রাখবো ছেড়ে দেবো না"
কারণ আমাদের নির্ধারিত হোটেল বিষ্ণুপুর টুরিস্ট লজ যেটা মেলার খুব কাছেই ফলে চারিদিকের বেশ কিছু রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হয় আর তার জন্য আমাদের আরো প্রায় ঘন্টখানেক ঘুরে বেড়াতে হয় হোটেলে পৌঁছানোর জন্যে।কারণ গাড়ির ড্রাইভার এবং আমরা সবারই প্রথম বিষ্ণুপুর যাওয়া তাই কিছুই চেনা নেই।
মা ছিন্নমস্তার মন্দির
হোটেলে ফোন করলে বলা হয় "আশপাশের লোকজন কে জিজ্ঞাসা করুন তারা বলে দেবে "এতে তাদের বেশ দায়িত্বজ্ঞানহীনের প্রকাশ পাওয়া যায়। পরে অভিজ্ঞতা আরো খারাপ হয় তাদের বানানো চাইনিজ মিক্সড ফ্রাইড রাইস খেয়ে যিনি বানিয়েছিলেন তিনি পোলাও এর সাথে মনে হয় গুলিয়ে ফেলেছিলেন তাই যথেচ্ছ চিনি দেওয়া যেটা খাবারের সাথে মেশে নি পর্যন্ত এবং খাবারের পরিমাণ খুবই কম।এই আতিথেয়তা কে সঙ্গে করে রাতে নিদ্রা যাই।
দলমাদল কামানসকালে ফুলকো লুচির তরকারি আর নলেন গুড়ের রসগোল্লা আর গরম গরম চা খেয়ে হৃদয় তৃপ্ত হলে মন্দির দর্শনে বেরিয়ে পড়ি। শুরু হয় রাসমঞ্চ দিয়ে যা কোনো মন্দির নয়। এটি বানিয়েছিলেন ১৬০০ সালে রাজা বিরহাম।জানা যায় বিষ্ণুপুরের রাজারা এসেছিল রাজস্থান থেকে আর সেখান থেকে আসার পর তারা একসময় বৈষ্ণব হয়ে গিয়েছিল।
যদুভট্ট মঞ্চ
সমস্ত বিষ্ণুপুরের রাধাকৃষ্ণের মন্দির থেকে মূর্তিগুলো একজায়গায় নিয়ে এসে শুরু করে রাস উৎসব।তাই নাম দেওয়া হয়েছিল রাস মঞ্চ।এই রাস মঞ্চ টি তিনটি ধর্মের সমন্বয় কে মাথায় রেখে তৈরি করা হয়।মাথার ওপরের দিকটা পিরামিডের মতো(ধাপ বা স্টেপ পিরামিড),মাঝখানটা তৈরি করা হয় বাংলার ঐতিহ্য বজায় রেখে দোচালা - চারচালার ন্যায়( চারটে কোণে যেটা দেখা যাচ্ছে সেটা চারচালা - বাংলা মন্দিরের ন্যায়,যেটা বড় সেটা দোচালা),এবং নিচের দিকটা ইসলামিক স্থাপত্যের নিদর্শন পাওয়া যায়।এর পর যাই শ্যামরাই মন্দির।
ডোকরার অনবদ্য সৃষ্টি বিষ্ণুপুরের ঐতিহ্য
শিল্পীদের কুর্নিশ না করলে নিজেকেই ছোটো মনে হবে নিজের কাছে।রাস চক্র থেকে শুরু করে শ্রী রামের যুদ্ধের বর্ণনা অবাক হতে হয় কি অক্লান্ত পরিশ্রমের সৃষ্টি তারা করে গেছে।প্রতিটি কাজ এত নিখুঁত ও নিপুণ ভাবে সম্পন্ন করা যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।
বনলতা এমু পাখি
ধীরে ধীরে এগিয়ে যাই জোড়া বাংলা মন্দির, মদনমোহন মন্দির, রাধামাধব মন্দির দর্শনে।এর পর যাই মা ছিন্নমস্তা মন্দিরে যেখানে মায়ের ছবি তোলা নিষেধ তাই দর্শন করে দলমাদল কামান দেখা হয়ে গেলে যাই মা মৃন্ময়ী দেবীর মন্দিরে।গঙ্গা মাটি দিয়ে তৈরি বলে মায়ের নাম দেওয়া হয়েছে মৃন্ময়ী।মূর্তিতে শেষ রঙ করা হয়েছে ২০১৮ সালে তাও নাকি স্বপ্নাদেশ পাওয়ার পর।পাশেই রাখা আছে একটি ছোটো কামান যা নাকি অষ্টমী এবং নবমী পুজোর সন্ধিক্ষণে অর্থাৎ সন্ধিপুজো শুরু হয় ওই কামান ফায়ারিং করে।তারপর পথে পরে যদু ভট্ট মঞ্চ যিনি বিষ্ণুপুরের কাদাকুরি গ্ৰামে জন্মেছিলেন এবং ছোট বয়সে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সংগীতের শিক্ষক ছিলেন। এরপর আমরা চলে যাই গনগনিতে মা নাকি বাংলার গ্ৰ্যান্ড ক্যানিয়ন। ভীষন সুন্দর ভাবে প্রকৃতি তার রূপকথায় সাজাতে চাইলেও কিছু মানুষের জন্যে তার সুন্দরতা হারাতে চলেছে। খুব শীঘ্রই এর ব্যবস্থা নেয়া দরকার।না হলে অচিরেই তা নষ্ট হবে।
লাল মাটির পথে
এবার ফেরার সময় তাই দ্বিতীয় দিনে আমরা প্রথমেই পৌঁছে যাই জয়পুর জঙ্গলে (জঙ্গল যেমন হয় ঠিক সেইরকম কোনো বিশেষ প্রাণীর দেখা আমরা পাই নি তবে ভালো লেগেছে প্রকৃতির নিজস্ব সৃষ্টিকে উপভোগ করতে),,,,,কিছুটা সময় কাটিয়ে বনলতা তে দুপুরের আহার সেরে কলকাতা ফেরা।
কিছু জরুরী তথ্য -----------
***কলকাতা থেকে ড্রাইভার সমেত বিষ্ণুপুর যাওয়া আসা Innova Crysta তে ১২০০০ মতো।
***হোটেল দুদিন (Bishnupur tourist lodge) ট্যাক্স সমেত ১০০০০ মতো (breakfast free)।
***বনলতা তে একবেলার আহার ১৩০০-১৪০০।