Thursday, February 6, 2020

মৃত্যুর মুখে সুন্দরবনে - ( পর্ব.. দুই) - In the face of death in the Sundarbans (2nd Part)

 ঘুম ভাঙলো খুব সকালে, আলোর আভা পেলেও সূর্য এখনো ওঠেনি। নৌকা একটা নদীর একপাশে নোঙ্গর করা। 'সুদাম' চা বানিয়ে হাতে ধরালো, এক চুমুক মারতেই, ব্যাস, তৎক্ষণাৎ নিম্নচাপ এসে হাজির। নৌকোর পিছনে ছোট ঘেরা জায়গাও আছে, ক্রিয়াকর্ম করার। স্মার্টলি গামছা পরে ভিতরে মাথা নিচু করে ঢুকেই আত্মারাম খাঁচা। মধ্যিখানে ছোট গর্ত, আর দুদিকে পা রাখার জায়গা প্রায় নেই। গর্ত দিয়ে নদীর জল দেখতে পাচ্ছি। সাঁতার জানি না, ঘাবড়ে গিয়ে প্রেসার হাওয়া। ফেরত চলে এলাম। সুদামকে কাছে টেনে বললাম, হবে না, ভাই, কিছু কর। সঙ্গে সঙ্গে সুদাম

সমস্যার সমাধান করে দিলো। সমাধানটা হলো, কোমরে দড়ি বেঁধে নৌকার সাইডে পা এর সাপোর্ট রেখে নদীর দিকে পশ্চাৎদেশ রেখে ঝুলে পরা। এতো সহজে আমার সমস্যা মিটে যাবে, বুঝি নি।
গামছা ছেড়ে প্যান্ট পরে নিলাম। আমার দ্বারা সম্ভব নয়।
আস্তে আস্তে চোখের সামনে নদী ফুঁড়ে সূর্য উঠছে। পুরো লাল। চট করে নৌকার ছাউনির মাথায় উঠে গেলাম। আমার দেখাদেখি মাঝিও এলো। সামনে আমাদের বিশাল নদী, নাম "ঠাকুরানী"। সুদাম আবার চা নিয়ে এসে আমার বিরোক্তিসূচক আওয়াজ শুনে দু পা পিছিয়ে গেল।
খেয়াল করেছেন তো ? সমস্যাটা কিন্তু এখনো আছে। পেট থেকে নানান শব্দ হচ্ছে, ও বেচারির কোনো দোষ ও নেই, ও তো এইসব ব্যাপারে অভ্যস্ত নয়। মাঝিকে বলেই ফেললাম, কিছু একটা করুন প্লিজ। মাঝি মুচকি হেসে বললো, নৌকো নিয়ে কোনো গ্রাম সংলগ্ন চড়ে দাঁড়াচ্ছি, কাদামাটিতে নেমে আড়াল দেখে সেরে ফেলুন। পাশ থেকে কে একজন বললো, হ্যা, হ্যা ঠিক আছে। মাথা ঘুরিয়ে দেখি, আরো দুজন কখন ছাউনিতে উঠে বসে আছে।
সে কি বলবো, আপনাদের। নৌকা পুরো চড়ে ঠেকলো না, শুধু গামছা পরে আমরা ঝাঁপ মারছি নৌকো থেকে, আর পড়েই হাঁটু অবধি গেঁথে যাচ্ছি। নিজেকে সামলে ছিলাম নাকি গামছা সামলে ছিলাম, ঠিক মনে নেই। সামনেই গ্রামের বাঁধ বাঁধানো রাস্তা। অনেক ছোট ছোট গাছ জন্মেছে বাঁধের গায়ে। খেয়াল করলাম গ্রামের অনেকেই কাজ সারে এখানে। একটা ছোট্ট গাছের আড়ালে গিয়ে বসে পড়লাম। হাতে গাছটা ধরে আছি, গড়িয়ে পড়লেই গড়াতে গড়াতে,মাখতে মাখতে কাদামাটিতে পরবো । গ্রামের লোকজন কিছুটা মাথার উপরের রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করছে। হাসির আওয়াজও পাচ্ছি। আমি মাথা গুঁজে নিয়েছি , হটাৎ খেয়াল করলাম, ছোট্ট গাছের গুঁড়িটা আমার হাতে উপড়ে আসছে।
সুদাম জাল নিয়ে এসেছিল, জানতাম না। ঝুপঝুপ করে নদীতে জাল ফেলছে, আর কুচো চিংড়ি উঠে আসছে। বা রে, মুড়ি,আলু ভাজা, কুঁচো চিংড়ি ভাজা আর সঙ্গে চা। আহা, গোগ্রাসে গিলছি। আলো পুরোদমে ফুটে গেছে। নদীটা খেয়াল করলাম ভালো করে। ভাবলাম ওপারেই গভীর জঙ্গল। কিন্তু মাঝি নিরাশ করে বললো, আরো যেতে হবে, মাতলা হয়ে দেউলবাড়ি বা কলস দ্বীপের কাছাকাছি।
জঙ্গলের কিছু নিজস্ব নিয়ম আছে। যেমন, 1,কারুর নাম ধরে ডাকা যাবে না। তাতে সে "বড়ে মিয়াঁর" টার্গেট হয়ে যাবে। 2, জঙ্গলে সরাসরি হিসু করা যাবে না, প্রথমে কোনো গাছের পাতায়, তারপর সরাসরি। জঙ্গল কে সম্মান জানানোর জন্য 3, নদীতে এক নৌকা আরেক নৌকাকে সব share করবে, কিন্তু ইঞ্জিনের তেল দেবে না।(ডিজেল)। সব কটাই কুসংস্কার হলেও ওই পরিবেশে না বলার স্পর্ধা কারুর হবে না।
ঠিক মনে নেই, আমরা কুলতলি বা তার আশপাশ থেকে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের পারমিশন করলাম। অফিসার খুব সন্দেহের দৃষ্টি দিয়ে আমাকে দেখছিলেন। প্রত্যেকটা নিয়মকানুন ভালো করে মুখস্থ করালেন, পরীক্ষা নিলেন। পাস করলাম। তারমধ্যে দুটো শর্ত ছিল, কোর এরিয়া ছেড়ে বাফার জোনে ঘুরতে হবে আর দ্বিতীয়টি ছিল ভুলেও খাঁড়িতে ঢোকা যাবে না। আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম কিন্তু জানতাম কোর এরিয়া তেই আমরা যাচ্ছি। কেন ওনারা সাবধান করেন, আমার গল্পটাই সাক্ষী।
যাই হোক, নৌকা রওনা দিলো মাতলার দিকে। নদীর একটা ঠান্ডা হাওয়া হয়, আমরা সবাই রোদ পোয়াছি। গ্লাসে আবার আওয়াজ উঠেছে সঙ্গে গরম কুঁচো মাছ ভাজা। বেশ ঘন্টাখানেক গেছি, হটাৎ নৌকা ধা করে বাঁয়ে ঘুরে গেল। সামনেই জঙ্গল। মাঝির দিকে তাকালাম, উত্তর দিলো "বনবিবির" মন্দির, একটু ধুপ জ্বালিয়ে নেবো।
আমি বললাম, এই জঙ্গলে ? বললো, হ্যা, চলুন না, আমরা আছি তো, আপনার ভয় কি আর তাছাড়া জঙ্গলের মজা নিতেই তো এসেছেন। ভাবলাম,যুক্তি আছে...ঠিক ঠিক।
নৌকোটার সামনের অনেকটা অংশ গাছপালার মধ্যে ঢুকে গেল। যেই ইঞ্জিন বন্ধ হলো, অমনি হটাৎ নিস্তব্দ হয়ে গেল। ফিসফিসিয়ে কথা বলছি আমরা। জঙ্গলের একটা ছোট অঞ্চল পরিষ্কার করা। সেখানে কাদামাটির তৈরি একটা ঘেরা জায়গার মধ্যে বনবিবির মূর্তি বসানো। সবাই নামলাম। কোনো অপ্রয়োজনীয় আওয়াজ ছাড়াই ধুপ জ্বালিয়ে পুজো হলো। কিন্তু তারপরই যেটা হলো , সেটার জন্য মোটেই তৈরি ছিলাম না। বাবুরা হটাৎ "হেতাল" গাছের গুঁড়ি কাটতে উদ্যোগী হলো। কি সব ওষুধ তৈরি করবে। আমি ওদের যেতে দেব না, আর ওরা যাবেই। একপ্রকার তর্ক শুরু হয়ে গিয়েছিল প্রায়। সিদ্ধান্ত হলো, ওরা সবাই যাবে আর আমি একা নৌকায় থাকবো। মাথা গরম হয়ে গেল। এই গভীর জঙ্গলে আমার সঙ্গে আসা চারজনের মধ্যে একজনেরও কিছু হয়ে গেলে আমি আর বাড়ি ফিরতে পারবো না। দু চারটে দু অক্ষর,চার অক্ষর মুখ দিয়ে বেরিয়েই গেল। মাঝি আমার খুব কাছে এসে বললো..বাবু, এই জঙ্গলে আমি রেগুলার আসি আর আমার হাতের এই চপার টা দেখুন, আমিও একটা বাঘ। আমি উত্তেজিত হয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিলাম, ওরা সেটাকে ভ্রূক্ষেপ না করে গভীর জঙ্গলে ঢুকে গেল।
কিছুক্ষন ওদের গলার আওয়াজ পেলাম তারপর সব মিলিয়ে গেল। আমি একা, নদীর ঠান্ডা হাওয়াটা আরো ঠান্ডা লাগছে। সিরসিরিয়ে উঠছি।
চারিদিক নিস্তব্দ। পাতায় পাতায় একটা জঙ্গুলে আওয়াজ হচ্ছে, বুকের মধ্যে দ্রিম দ্রিম আওয়াজ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি। বনবিবির মন্দিরের আশপাশে অনেক লাল, সাদা, বুনো ফুল ফুটে আছে। নদীর হওয়ায় সব গাছগুলো দোল খাচ্ছে, হটাৎ তারমধ্যে একটা ফুলগাছ একটু বেশিই নড়ে উঠলো। ঘাবড়ে গিয়ে নৌকোর মধ্যিখানে খোপ কেটে যেখানে ইঞ্জিন বসানো, ওর পাশটায় চলে গেলাম। কিছু এলে ইঞ্জিন ব্লকে ঢুকে যাবো। কানটা ভালো করে পেতে শুনতে পেলাম, খুব মৃদু একটা পায়ে চলা আওয়াজ আমার দিকে এগিয়ে আসছে....
ক্রমশ....



Personal Experience - Rajib Bashu

0 comments:

Post a Comment